মৃত্তিকা সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক গুলি আলোচনা করো


পৃথিবীর সর্বত্র এক ধরণের মাটি নেই কারণ কোথায় কী ধরণের মৃত্তিকা সৃষ্টি হবে তা কয়েকটি নিয়ন্ত্রকের ওপর নির্ভর করে রাশিয়ান মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডকুচেভ মৃত্তিকা গঠনের ওপর চারটি নিয়ন্ত্রক যথাজলবায়ু, জীবজগত, শিলা সময়ের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জেনির মতে মৃত্তিকা সৃষ্টির পাঁচ টি নিয়ন্ত্রক আছে মৃত্তিকা সৃষ্টি প্রসঙ্গে জেনি প্রদত্ত সমীকরনটি হল – S = f (Cl, O, R, P,T ) যেখানে S = মৃত্তিকা, f = কার্যকারন, Cl = জলবায়ু, O = জীবজগত, R = ভূ-প্রকৃতি, P = আদিশিলা, T = সময়

মৃত্তিকার সংজ্ঞা দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভৌত, রাসায়নিক, জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদি শিলার পরিবর্তনের ফলে ভূপৃষ্টের সমান্তরালে বিভিন্ন খনিজ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ যে পাতলা ভঙ্গুর আবরনী স্তর সৃষ্টি হয়, যা উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক, তাকে মৃত্তিকা বলে

মৃত্তিকা সৃষ্টির কারণ গুলিকে কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে দুভাগে ভাগ করা যায় যথা
                       ক) সক্রিয় কারণ     ) নিস্ক্রিয় কারণ  


) সক্রিয় কারণ  - জলবায়ু জীব জগত হল মৃত্তিকা সৃষ্টির সক্রিয় কারণ এরা মৃত্তিকা গঠনের জন্য শক্তি জোগায় রেগোলিথকে সক্রিয় ভাবে পরিবর্তন করে

. জলবায়ুর প্রভাব মৃত্তিকা সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কারণ হল জলবায়ু জলবায়ুর প্রভাবে গঠিত মাটি সমূহ এক্টোডায়নামোমরফিট মাটি নামে পরিচিত বৃষ্টিপাত তাপমাত্রা জলবায়ুর এই দুটি উপাদান প্রত্যক্ষ ভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টিতে অংশ গ্রহন করে

বৃষ্টিপাতের ভূমিকা

➤ বৃষ্টিপাতের পরিমান যেখানে বেশি যেমন আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে আবহবিকার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এই কারণে আর্দ্র অঞ্চলের মাটিতে কাদার পরিমান বেশি থাকে যেমন এটেল মাটি

➤ বৃষ্টিপাতের পরিমান বেশি হলে আম্লিক প্রকৃতির হয়

➤ বৃষ্টিপাতের পরিমান বেশি হলে মাটিতে উদ্ভিজ্জের আবরন ঘন হয় মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমান বাড়ে

➤ অতি বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে মৃত্তিকার স্তর গুলি পুরু হওয়ার ফলে গভীর মাটির সৃষ্টি হয় সাধারণত বৃষ্টিপাতের পরিমান যত কমে মৃত্তিকা তত অগভীর হয়

➤ মরু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অল্প হওয়ায় আবহবিকারের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম প্রভৃতি খনিজ গুলি মৃত্তিকার ঊর্দ্ধস্তর থেকে অপসিত হয় হয় না ফলে মৃত্তিকা ক্ষারকীয় প্রকৃতির হয়

➤ বাষ্পীভবন অপেক্ষা বৃষ্টিপাত কম হলে কৈশিক প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার নিচ থেকে উপরের দিকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট লবন উঠে আসে মাটির ওপরের স্তরে সঞ্চিত হয়

তাপমাত্রার ভূমিকা

➤ বিজ্ঞানী ভ্যানডফের মতে প্রতি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই শীতল মরু অঞ্চলের তুলনায় উষ্ণ ক্রান্তীয় নিরক্ষীয় অঞ্চলে মৃত্তিকা সৃষ্টির হার দ্রুত।

➤ তাপমাত্রা বাড়লে আবহবিকারের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে পুরু রেগোলিথের উৎপত্তি হয় এবং মাটির গভীরতা বাড়ে।

➤ অধিক উষ্ণ অঞ্চলের মাটি তে জৈব পদার্থের পরিমান কম হয় এবং নাইট্রোজেনের পরিমান হ্রাস পায়।

➤ তাপমাত্রা বেশি হলে মাটিতে কাদা জাতীয় খনিজ যেমনমন্টমোরিলোনাইট, কেওলিনাইট ইত্যাদির পরিমান বেশি হয়।

➤ অধিক তাপমাত্রার জন্য মরু মরু প্রায় অঞ্চলের মাটি শুষ্ক লবনাক্ত হয়।



. জীব জগতের প্রভাব উদ্ভিদ প্রানী জগতের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় যেমন

➤ প্রানী উদ্ভিদের মৃত দেহাবশেষ বিয়োজিত হয়ে মাটিতে হিউমাস রূপে সংযোজিত হয়, ফলে মাটির পুষ্টি গুন বাড়ে মাটি উর্বর হয়।

➤ মাটিতে হিউমাসের পরিমান বাড়লে মাটির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে।

➤ উদ্ভিদের শিকড় শিলায় প্রবেশ করে জল বাতাসের চলাচলের পথ সৃষ্টি করে দেয়।

➤ মাটির গর্তে বসবাস কারী প্রানীরা যেমন কেঁচো, খরগোশ, পিঁপড়ে, ইঁদুর ইত্যাদি মাটির ওপর নিচের স্তরের মধ্যে মিশ্রন ঘটায় ফলে বায়ু চলাচল করা সহজ হয় এবং মৃত্তিকা আলগা হয়।

➤ কেঁচোর মল নাইট্রোজেন ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ার ফলে কেচোর উপস্থিতি মাটি কে উর্বর করে।

) নিস্ক্রিয় বা পরোক্ষ কারণ 

যে সমস্ত কারণ গুলি জলবায়ু জীব জগতের মতো অতটা সক্রিয় নয়, তবে মৃত্তিয়াক সৃষ্টির তে পরোক্ষ ভাবে অংশ গ্রহন করে, তাদের কে নিস্ক্রিয় কারণ বলে যেমন ভূ-প্রকৃতি, আদিশিলা সময়

. ভূ-প্রকৃতির ভূমিকা ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, বন্ধুরতা ঢাল প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভাবে মৃত্তিকার সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে এখানে উল্লেখ করা যায় যে, একই প্রকার আদিশিলা জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলে ভূপ্রকৃতির পার্থক্যের জন্য স্থানীয় ভূমিরূপ অনুসারে যে মৃত্তিকা গঠিত হয় তাকে মৃত্তিকা ক্যাটেনা বলে মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূ-প্রকৃতির প্রভাব নিচে আলোচনা করা হল

➤ পাহাড়ি অঞ্চলের ভূমির ঢাল অনেক বেশি অধিক ভূমি ঢালের জন্য এখানে ভূমিক্ষয়ের পরিমান বেশি, ফলে এই অঞ্চলের মাটি অগভীর পাতলা স্তর বিশিষ্ট হয়।

➤ মাঝারি ঢালযুক্ত ভূমিতে মাটির গভীরতা মাঝারি ধরণের এবং সমভূমি অঞ্চলে যেখানে ভূমির ঢাল কম সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে মাটিতে অনুস্রবন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। ধৌত প্রক্রিয়ায় দ্রাব্য পদার্থ গুলি উপরের স্তর থেকে অপসারিত হয় ফলে মাটির গভীরতা বেশি হয়।

➤ উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত উচ্চভূমির দক্ষিন ঢাল উত্তর ঢালের তুলনায় বেশি আলোকিত উষ্ণ। এই কারণে উত্তর ঢালে পডসল মৃত্তিকা এবং দক্ষিন ঢালে ক্ষারকীয় মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।


. আদিশিলার প্রভাবআবহবিকার, ক্ষয় সঞ্চয়ের মাধ্যমে আদিশিলা পরিবর্তিত হয়ে মৃত্তিকার সৃষ্টি করে। আদিশিলার ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মাটিকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে। যেমন

➤ গ্রানাইট রায়োলাইট শিলা থেকে বেলেমাটি উৎপন্ন হয়। বেলেমাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকায় জলধারণ ক্ষমতা কম হয়।

➤ ব্যাসল্ট শিলা থেকে এঁটেল মাটি উৎপন্ন হয়। এই মাটি মৃদু ক্ষারকীয় এবং জলধারন ক্ষমতা বেলে মাটির তুলনায় বেশি।

➤ শিস্ট শিলা থেকে উৎপন্ন মাটিতে কাদার কনা বেশি হয়। এই মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম ম্যাগনেশিয়ামের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।

➤ আদি শিলায় কোয়ার্টজের পরিমান বেশি হলে মাটি ধূসর বা হালকা সাদা রঙের হয়।

➤ আদিশিলায় লোহা ম্যাঙ্গানিজের আধিক্য হলে লাল রঙ ধারন করে।

➤ আদিশিলায় চুনের পরিমান বেশি থাকলে মাটি দৃঢ় সুগঠিত হয়।   

৩. সময়ের প্রভাব – প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি পরিনত মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে কয়েক হাজার বছর সময় লাগে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের মতে মাত্র দুই সেমি পুরু মাটির স্তর তৈরি হতে কয়েকশো বছর সময় নেয়। তাই মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর।


➤ দীর্ঘ সময় ধরে যে পরিমান মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়, সেই মাটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন – ল্যাটেরাইট, পডসল, চারনোজেম ইত্যাদি। পরিনত মৃত্তিকায় প্রতিটি স্তরই সুগঠিত হয়।

➤ অল্প সময়ে মাটির স্তর গুলো ভালো ভাবে গড়ে উঠতে পারে না। ফলে অপরিনত মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।

➤ আদিশিলার কাঠিন্যের ওপর মৃত্তিকা সৃষ্টির সময় নির্ভর করে। যেমন – শেল শিলা থেকে মৃত্তিকা দ্রুত গঠিত হয় কিন্তু কঠিন নাইস শিলা থেকে মৃত্তিকা গঠনের হার অতি ধীর।  

সময় ও মৃত্তিকার মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মাটিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। নিচের সারনীতে এই পর্যায় গুলি দেখানো হল

পর্যায় অনুসারে মৃত্তিকা
মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য
১. প্রারম্ভিক মৃত্তিকা (Initial Soil)
অতি অপরিণত মৃত্তিকা। আদি শিলার পরিবর্তন শুরু হয়নি।
২. তরুন মৃত্তিকা ( Juvenile Soil)
মাটিতে প্রাথমিক খনিজের প্রাধান্য থাকে।
৩. যৌবন পর্যায়ে মৃত্তিকা (Verile Soil)
মাটিতে কাদার কনা ও গৌন খনিজ  বেশি থাকে।
৪. অন্তিম যৌবন পর্যায়ের মৃত্তিকা (Senile soil)
মাটিতে বিয়োজিত খনিজের প্রাধান্য থাকে।
৫. পরিনত। মৃত্তিকা (mature soil)
মাটি সৃষ্টির প্রক্রিয়া প্রায় সমাপ্ত। মৃত্তিকা পরিলেখে সকল স্তরের সুস্পষ্ট অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।



কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.