মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা কর ।।


মৃত্তিকা হল এমন এক প্রাকৃতিক বস্তু, যা জলবায়ু, জীবমণ্ডল, অধঃস্থিতশিলা, ভূ-প্রকৃতি প্রভৃতি নিয়ন্ত্রক গুলির দীর্ঘকালীন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ফল। এই মৃত্তিকার গুনাগুন নির্ভর করে বিভিন্ন ধরণের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যের উপর। মৃত্তিকা অনেকগুলি জটিল ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়। তাই বিভিন্ন মৃত্তিকার মধ্যে শুধু নয়, একটি মৃত্তিকার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতি অনুযায়ী মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য গুলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন – ক) মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য এবং খ) মৃত্তিকার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য  

নীচে বিস্তারিতভাবে মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য গুলি সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে আলোচনা করা হল –

মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য – মৃত্তিকার যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ চোখে দেখে বোঝা যায়, সে গুলিকে মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য বলে। মৃত্তিকার গ্রথন, গঠন, ঘনত্ব, সচ্ছিদ্রতা, স্ফীতি, জলধারনক্ষমতা, সংকোচন, সংসক্তি, নমনীয়তা, বর্ন প্রভৃতি হল মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম। এরা প্রত্যেকে মৃত্তিকার প্রকৃতি নির্ধারনের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা গ্রহন করে থাকে। মৃত্তিকার এই ভৌত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নীচে আলোচন করা হল –

মৃত্তিকার গ্রথন [ Soil Texture ] :  মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম গুলির মধ্যে মৃত্তিকার গ্রথন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৃত্তিকার মধ্যে বিভিন্ন আয়তনের কনা গুলি, যেমন – পলি,বালি, কাদাকনার আপেক্ষিক আনুপাতিক পরিমান হল মৃত্তিকার গ্রথন, যা মৃত্তিকার সূক্ষ্মতা এবং স্থূলতাকে নির্দেশ করে। মৃত্তিকার বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে মৃত্তিকার গ্রথন প্রভাবিত করে। মৃত্তিকার কনা গুলির মধ্যে বড় কনা গুলিকে বলে বালুকনা, মাঝারি কনা গুলিকে বলে পলিকনা এবং ক্ষুদ্র কনা গুলিকে কাদাকনা বলে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীগন মৃত্তিকাকনা গুলিকে আকারের পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগ গুলিকে মৃত্তিকা বিভেদ বলে।

আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসারে মৃত্তিকা কনার শ্রেণীবিভাগ

মৃত্তিকার বিভেদ
ব্যাস (মিলিমিটার)
মোটা বালিকনা
২.০ – ০.২
মিহি বালুকনা
০.২ – ০.০২
পলিকনা
০.০২ – ০.০০২
কাদাকনা
< ০.০০২

মৃত্তিকার গঠন [ Soil Structure ] : গ্রথনের ন্যায় মৃত্তিকার গঠনও একটি গুরুত্বপূর্ন ভৌত ধর্ম। মৃত্তিকার কনাগুলির পারস্পারিক সজ্জারীতির মাধ্যমে যে বিন্যাস প্রদর্শন করে তাকে মৃত্তিকার গঠন বলে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্তিকার বিভেদ গুলি একত্রিত অবস্থায় থেকে এক একটি একত্রন বা পেড গঠন করে। এই পেড গুলি সম্মিলিত হয়ে অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর একক গঠন করে। উক্ত বৃহত্তর একক গুলির জ্যামিতিক আকারকেই মৃত্তিকার গঠন বলা হয়। মৃত্তিকার গঠন নানা রকমের হয়, যেমন – প্রিজম আকৃতি, স্তম্ভ আকৃতি, পাতের ন্যায়, চাই আকৃতি প্রভৃতি।

মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতা [ Water Holding Capacity ] : জলশোষন করা এবং মৃত্তিকার ছিদ্রের মধ্যে সেই জলকে ধরে রাখা মৃত্তিকার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গাছের গ্রহনের উপযোগী যে পরিমান জল জল মৃত্তিকা তার ছিদ্রে ধরে রাখতে পারে, তাকে বলে মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতা। সূক্ষ্ম ছিদ্র বা রন্ধ্রযুক্ত মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতা বেশি হয়, যেমন –কাদামৃত্তিকা

মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা [ Pore Space ] : একটি নির্দিষ্ট আয়তনের মৃত্তিকায় কঠিন কনার উপস্থিতি থাকে। এই কঠিন কনা গুলি পরস্পর ঘনসন্নিবিষ্ট ভাবে আবদ্ধ থাকে না তার মধ্যে কিছু ছিদ্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, এই ছিদ্র গুলিকেই মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা বা Pore Space বলে। বিভিন্ন মৃত্তিকার ছিদ্র গুলি বিভিন্ন রকমের হয়। যেমন – যে মৃত্তিকায় কাদা কনার পরিমান বেশি থাকে সেই মৃত্তিকার ছিদ্র গুলি ক্ষুদ্র হয় এবং যে মৃত্তিকায় বালি কনার পরিমান বেশি থাকে তার ছিদ্র গুলি বৃহৎ আকৃতির হয়।  

মৃত্তিকার বর্ন বা রঙ [ Colour of Soil ] : মৃত্তিকার বর্ন বা রঙ হল মৃত্তিকার একটি গুরুত্বপূর্ন ভৌত ধর্ম। আদিশিলা, জৈব পদার্থের পরিমান, জলনির্গমন, বায়ু চলাচল প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য দ্বারা মৃত্তিকার বর্ন নির্ধারিত হয়। এছাড়া মৃত্তিকা পরিলেখের বিভিন্ন স্তরের বর্ন থেকে ক্রিয়াশীল মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায়। মৃত্তিকার বর্ন থেকে জলবায়ুর প্রকৃতি সম্পর্কেও আমরা জানতে পারি।

মৃত্তিকার ঘনত্ব [ Density of Soil ] : প্রতি একক আয়তনের মৃত্তিকাতে যে পরিমান কঠিন পদার্থ থাকে, তার পরিমাণই হল মৃত্তিকার ঘনত্ব।

মৃত্তিকার সংকোচন ও প্রসারন [ Expansion & Contraction ]: মৃত্তিকা মধ্যস্থিত আর্দ্রতার পার্থক্যের ফলে মৃত্তিকার সংকোচন ও প্রসারন হয়। কাদামৃত্তিকা শুকিয়ে গেলে  আয়তনে কমে বা সংকুচিত হয়ে মৃত্তিকাতে ফাটলের সৃষ্টি করে। । আবার বৃষ্টি হলে মৃত্তিকার কনাগুলি এত স্ফীত হয় যে মৃত্তিকার উপরের স্তরে বন্ধুর ভূভাগের সৃষ্টি হয়। যেমন- এঁটেল মৃত্তিকা ও কৃষ্ণ মৃত্তিকায় এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

মৃত্তিকার সংহতি [ Consistence ] : বিভিন্ন আর্দ্রতায় মৃত্তিকার ভৌত অবস্থা মৃত্তিকার কনাগুলির সংহতিকে প্রভাবিত করে। মৃত্তিকার সংহতি নানা রকমের হয়, যেমন – নমনীয়তা, ভঙ্গুরতা, দৃঢ়তা, কঠিন, আলগা প্রভৃতি। যেমন – জল প্রয়োগে এঁটেল মৃত্তিকা নমনীয় হয়। মৃত্তিকার সংহতি নির্ভর করে সংশক্তি ও আসঞ্জন বলের উপর।  

মৃত্তিকার সংশক্তি [Cohension] ও আসঞ্জন [Adhesion] বল : মৃত্তিকা মধ্যস্থিত কনা গুলির পরস্পর সংযুক্ত থাকার ক্ষমতাকে সংশক্তি বলে। এই শক্তির জন্যই মৃত্তিকার ঢেলা গঠিত হয় আবার এর জন্যই সহজেই ভেঙে যায়।

মৃত্তিকা কনার নিজের মধ্যে জল ধরে রাখার ক্ষমতাকে আসঞ্জন বল বলে। মৃত্তিকার সংশক্তি ও আসঞ্জন বলের জন্যই কৈশিক জল ছিদ্রের মাধ্যমে নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরে উঠে আসে। মৃত্তিকায় আসঞ্জন বলের উপস্থিতি না থাকলে মৃত্তিকার উদ্ভিদের বৃদ্ধি সম্ভব হত না।  

1 টি মন্তব্য:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.