মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য গুলি কী কী
মৃত্তিকার যেমন ভৌত বৈশিষ্ট্য আছে তেমনি কিছু রাসায়নিক ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলি মৃত্তিকার গুনাগুন বা গঠন কে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে থাকে। মৃত্তিকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাসায়নিক ধর্ম হল – মৃত্তিকা বিক্রিয়া বা pH, মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা, জৈব পদার্থ
ও পুষ্টি মৌল । নিচে মৃত্তিকার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল ।
১. মৃত্তিকার রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং মৃত্তিকা pH –
মৃত্তিকার দ্রবন প্রক্রিয়ায় অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব অবস্থা মৃত্তিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ন রাসায়নিক ধর্ম। মৃত্তিকা দ্রবনে উপস্থিত হাইড্রোজেন ও হাইড্রোক্সিল আয়নের দ্বারা মৃত্তিকার ক্ষারকীয়তা ও অম্লত্ব কে বোঝানো হয়। সাধারন ভাবে হাইড্রোক্সিল আয়নের চেয়ে হাইড্রোজেন আয়নের পরিমান বৃদ্ধিতে মাটির দ্রবনে অম্লত্বের সৃষ্টি হয় এবং হাইড্রোজেন আয়নের চেয়ে হাইড্রোক্সিল আয়নের পরিমান বৃদ্ধিতে মৃত্তিকা দ্রবনে ক্ষারত্ব দেখা যায়।
মৃত্তিকা pH – মৃত্তিকার দ্রবনে কি পরিমান অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব আছে তা পরিমাপের স্কেল হিসাবে মৃত্তিকা pH ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানী সোরেনসন ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্তিকার অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব পরিমাপের জন্য pH স্কেল আবিষ্কার করেন। pH এর মান ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত হয়। মৃত্তিকা pH এর মান ৭ এর কম হলে মৃত্তিকা আম্লিক চরিত্রের এবং pH এর মান ৭ এর বেশি হলে মৃত্তিকা ক্ষারকীয় চরিত্রের হয়। মৃত্তিকা pH এর মান ৭ হলে ওই মৃত্তিকাকে প্রশমিত মৃত্তিকা বা নিরপেক্ষ মৃত্তিকা বলে।
২. মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা – মৃত্তিকার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ন। এটি মূলত উদ্ভিদ পুষ্টি মৌলের সাথে সম্পর্কীত। মৃত্তিকার উপাদান গুলির মধ্যে অন্যতম হল জৈব পদার্থ ও খনিজ পদার্থ বা পুষ্টিমৌল। জৈব পদার্থ ও খনিজ পদার্থ মধ্যস্থিত সূক্ষ্ম কনাগুলি ( <০.০০২ মিলিমিটার) কে বলে কলয়েড [Colloids]।
খনিজ কলয়েড [Mineral colloids] – শিলা ও খনিজ গুলি বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ক্রমাগত ক্ষয় পেতে পেতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম কনায় পরিনত হয়। এই সূক্ষ্ম কনা গুলিকে কাদাকনা বলে, যেমন – কেওলিনাইট, ইলিটি, মন্টমোরিলোনাইট প্রভৃতি। এই কাদা কনা গুলি মূলত ঋনাত্মক তড়িৎ [Negatively Charge] যুক্ত হয়।
জৈব কলয়েড [ Organic Colloids] – মৃত উদ্ভিদ ও প্রানী দেহের বিয়োজনের ফলে যে কালো রঙের সূক্ষ্ম দানা বিশিষ্ট হিউমাস গঠিত হয়, সেই হিউমাসের কনা গুলিও খনিজকনার মতো ঋনাত্মক তড়িৎ যুক্ত হয়।
মিশেল [Micelle] – ঋনাত্মক তড়িৎ যুক্ত জৈব ও অজৈব কলয়েড গুলিকে মিশেল বলে।
ক্যাটায়ন বিনিময় [Cation Exchange] – যেহেতু মিশেল গুলি ঋনাত্মক তড়িৎযুক্ত [অ্যানায়ন (-)] হয়, তাই এগুলি ধনাত্মক তড়িৎ যুক্ত কনা বা ক্যাটায়ন (+) গুলিকে নিজের দিকে আকর্ষন করে এবং এই আয়ন গুলি মিশেলের গায়ে এসে লেগে থাকে। এই ঘটনাটিকে বলে শোষণ। মূলত ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি খনিজ কনা গুলি কাদাকনা গায়ে লেগে থাকে এবং এদের সহজে সেখান থেকে সরানো যায় না। অন্য কোন ক্যাটায়ন (+) সেখানে অন্তর্ভুক্ত করলে তখনই তাদের সেখান থেকে সরানো সম্ভব হয়। এই ভাবে একটি ক্যাটায়নের দ্বারা অপর ক্যাটায়নের পরিবর্তন কেই মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা বলে।
যেমন – যখন মৃত্তিকায় অ্যামোনিয়াম সালফেট [(NH4)2SO4] মিশানো হয় তখন অ্যামোনিয়া (NH4) অন্য কোন ক্যাটায়ন দ্বারা পরিবর্তিত হয় মূলত ক্যালসিয়াম (Ca) আয়ন দ্বারা।
মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময়ের কারণ – মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন
ক) মৃত্তিকার বুনন বা গ্রথন – একটি মৃত্তিকায় বিভিন্ন আকৃতির মৃত্তিকা কনার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আর মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা নির্ভর করে ঋনাত্মক তড়িৎ যুক্ত কাদাকনার পরিমানের উপর। যে মৃত্তিকায় কাদাকনার পরিমান বেশি সেই মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা বেশি। তাই মৃত্তিকায় বালিকনা বেশি থাকলে মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা কম হয়।
খ) জৈব পদার্থ – জৈব পদার্থের সূক্ষ্ম কনাগুলিও অ্যানায়ন সমৃদ্ধ হয়। তাই যে মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমান বেশি থাকবে সেই মৃত্তিকার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা বেশি।
গ) কাদাকনার প্রকৃতি – সাধারণত কাদাকনা গুলি ক্যাটায়ন ধারন করতে সক্ষম। কিন্তু সব কাদা কনার ক্যাটায়ন ধারন করার ক্ষমতা সমান নয়। যেমন মন্টমোরিলোনাইট (৮০-১০০ m.
mole/100gm), ইল্লিটি (১৫০ m. mole/100gm) কনার ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা অনেক বেশি কিন্তু সেই তুলনায় কেওলিনাইটের (৩ - ১৫ m. mole/100gm) ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা খুবই কম।
ঘ) মৃত্তিকা বিক্রিয়া – মৃত্তিকায় এর পরিমান বৃদ্ধি পেলে হাইড্রোজেন আয়ন হাইড্রোক্সিল আয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খনিজ কাদাকনার এক কোণে অবস্থান করে। অর্থাৎ যা মৃত্তিকায় হাইড্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি করে। যার ফল স্বরূপ কেওলিনাইটের ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা অনেকটা বৃদ্ধি পায়।
৩. মৃত্তিকার জৈব পদার্থ [Organic Matter] – মৃত্তিকার উপাদান গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অংশ হল জৈব পদার্থ। উদ্ভিদ ও প্রানীর দেহাবশেষ বিভিন্ন অনুবীক্ষনিক বিয়োজকের দ্বারা বিয়োজিত হয়ে জৈব পদার্থ গঠন করে। মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্য গুলির বিকাশ সাধনে জৈব পদার্থ সাহায্য করে। মৃত্তিকার আয়ন বিনিময় ক্ষমতা নির্ভর করে জৈব পদার্থের প্রকৃতির উপর।
৪. পুষ্টি মৌল [Plant
Nutrients] – মৃত্তিকায় এমন কিছু খনিজ পদার্থ থাকে যে গুলি উদ্ভিদ বৃদ্ধির পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ন। এই খনিজ পদার্থ গুলিকে পুষ্টি মৌল বলে। মৃত্তিকায় উপস্থিত পুষ্টি মৌলের সংখ্যা প্রায় ১০০ বেশি, এর মধ্যে মাত্র ১৬ টি অত্যাবশ্যকীয় মৌল। এগুলি হল – কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, কপার, মলিবডেনাম, বোরন ও ক্লোরিন। যে পুষ্টি মৌল গুলি বেশি পরিমানে উদ্ভিদ দ্বারা ব্যবহৃত হয়, তাকে ম্যাক্রো পুষ্টিমৌল বলে, যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম এবং যে উপাদান গুলি খুব কম ব্যবহৃত হয় তাদের মাইক্রো পুষ্টি মৌল বলে, যেমন – ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি।
Darun lekhecen
উত্তরমুছুন