বিশ্ব উষ্ণায়নের কারন ও ফলাফল


বর্তমান সময়ে মনুষ্য সমাজের নিকট এক অতি গুরুত্বপূর্ন পরিবেশগত সমস্যা রূপে উদ্ভূত হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিশ্ব উষ্ণায়ন কেবলমাত্র পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। 

বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রার ক্রমান্বয় বৃদ্ধিকে বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা কেই বলা হয় বিশ্ব উষ্ণায়ন।

সাধারন অবস্থায় সূর্য থেকে পৃথিবীতে যে তাপ এসে পৌঁছায় তার প্রায় বেশির ভাগ অংশই পৃথিবী থেকে পার্থিব বিকিরন রূপে পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে নির্গত হয়ে যায়, ফল স্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকে। বায়ুমণ্ডলীয় কিছু গ্যাস রয়েছে যা পার্থিব বিকিরনের কিছু পরিমান তাপ শোষণ করে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে। এই গ্যাস গুলি গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়ে থাকে। গ্রিন হাউস গ্যাস গুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান গ্যাস গুলি হল কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, মিথেন, ওজোন ও নাইট্রাস অক্সাইড। পৃথিবীকে কাঁচের ঘরের মতো বেষ্ঠন করে থাকা এই গ্রিন হাউস গ্যাস বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প না থাকলে পৃথিবীর বর্তমান গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি থেকে কমে - ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেত। 

বিগত ১৫০ বছরের তাপমাত্রা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন ১০০ বছর পূর্বে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রার এই সামান্য তম পরিবর্তনে সময় লাগে কয়েক শত বছর। কিন্তু এই সামান্য পরিবর্তন পৃথিবীর ক্ষেত্রে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ন প্রভাব ফেলে । যেমন - হিমযুগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আজকের থেকে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গিয়েছিল ও হিমযুগ মধ্যবর্তী উষ্ণ সময়ে গড় তাপমাত্রা আজকের থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছিল, ফল স্বরূপ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৪- ৬ মিটার বেড়ে গিয়েছিল। 

বিগত ১৫০ বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ১৯১০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে আবার ১৯৪০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে তাপমাত্রা কিছু টা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু ১৮৫০ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে তাপমাত্রার তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায় নি। 

 ১৯৭০ সালের পর তাপমাত্রা অনেক দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রতি দশকে প্রায় ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। তাই পৃথিবীর উষ্ণতম বছর গুলি এই সময়ের মধ্যে অবস্থিত।  

বর্তমানে মানুষের কিছু অবিবেচনা প্রসূত কাজ কর্মের জন্য এই গ্রিন হাউস গ্যাস গুলির পরিমান স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছে, যার ফলে এই গ্যাস গুলির দ্বারা শোষিত তাপের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রার পরিমান বেড়ে গিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে।  

United Nation এবং World meteorological Organization  ১৯৮৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি অনুসন্ধানের জন্য Intergovernmental Panel on Climate Change বা IPCC গঠন করেন। এই IPCC এর রিপোর্ট অনুসারে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং তার সঙ্গে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ সেমি বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আরো অনুমান করেছেন যে আগামী ১০০ বছরে অর্থাৎ ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো ১.৪ ডিগ্রি থেকে ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ২০ থেকে ৮৮ সেমি পর্যন্ত। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব কেবলমাত্র কেবল মাত্র বায়ুমন্ডলীয় উষ্ণতা ও সমুদ্র তলের উচ্চতার পরিবর্তনের সাথে যুক্ত নয়, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আজ আবহাওয়ার গতি প্রকৃতির আগাম পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এবং জলবায়ুগত দূর্যোগ যেমন খরা, বন্যা ও ঝড় প্রভৃতির পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

আমরা পৃথিবীব্যাপী এই উষ্ণায়নের কারণ অনুসন্ধান করি তাহলে দেখতে পাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ হল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস গুলির পরিমান বৃদ্ধি। প্রধান প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস, তাদের উৎস এবং উষ্ণকরনে এই গ্যাস গুলির ভূমিকা সম্পর্কে আমরা এখানে আলোচনা করবো।  

 
বিশ্ব উষ্ণায়নে গ্রিন হাউস গ্যাস গুলির ভূমিকা 

কার্বন ডাই অক্সাইড - গ্রিন হাউস গ্যাস গুলির মধ্যে প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস হল কার্বন ডাই অক্সাইড। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান খুবই কম মাত্র ০.০৩৬%। পরিমানে কম হলেও কার্বন ডাই অক্সাইড উষ্ণকরনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। শিল্প বিপ্লবের সময় ১৭৫০ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান ছিল ২৮০ PPM কিন্তু তার পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানীর অতিরিক্ত দহনের ফলে এই কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে আজ পরিমান হয়েছে ৩৮০ PPM। ১৯৯৫ সালে থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে প্রতি বছরের কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১.৯ PPM।

মিথেন - অপর এক গুরুত্বপূর্ন গ্রিন হাউস গ্যাস হল মিথেন । মিথেন গ্যাসের প্রধান উৎস হল জলাভূমি, এছাড়া চাষের জমি, গবাদি পশুর মলমূত্র, উদ্ভিদ ও প্রানীর মৃত দেহ প্রভৃতি । এই মিথেন গ্যাসের উষ্ণকরন ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় প্রায় ২৩ গুন বেশি। 

নাইট্রাস অক্সাইড - বায়ুমণ্ডলের এই গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমান খুব কম মাত্র ০.৩ PPM এবং প্রতিবছর এই গ্রিন হাউস গ্যাস প্রায় ০.২৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে পূর্বের তুলনায় ১৬% ।মূলত মনুষ্য কার্যকলাপ তথা কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের বৃদ্ধির প্রধান কারণ। 

ক্লোরোফ্লোরোকার্বন ও ওজোন - রেফ্রিজারেটার, এয়ার কন্ডিশনার, স্প্রে ক্যান থেকে নির্গত CFC গ্যাস বায়ুমণ্ডলে প্রায় ১০০ - ২০০ বছর স্থায়ী হয় এবং ১৯৮০ এর দশক থেকে এই গ্যাসের ব্যবহার তথা বায়ুমণ্ডলে CFC পরিমান ক্রমশ বাড়তে থাকে। বায়ুমণ্ডলে CFC পরিমান কম হলেও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের তুলনায় CFC উষ্ণকরন ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। যেমন - কার্বন ডাই অক্সাইডের সাপেক্ষে CFC গ্যাসের উষ্ণকরন ক্ষমতা প্রায় ৫০০০ থেকে ১০০০০ গুন বেশি। 

ওজোন গ্যাসও উষ্ণকরনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ অক্ষাংশীয় অঞ্চলে ওজোন CFC  দ্বারা বিশ্লেষিত হয় বলে, সেখানে ওজোন গ্যাসের প্রভাব তেমন দেখা যায় না কিন্তু ক্রান্তীয় অঞ্চলে ওজোন বিশ্লেষণের পরিমান কম হওয়ায় ওজোন গ্রিন হাউস গ্যাস রূপে উষ্ণকরনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিমানের প্রপেলার থেকে নির্গত নাইট্রোজেনের অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ওজোন গ্যাসের প্রধান উৎস। 


বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলাফল 

জলবায়ুর পরিবর্তন - বিগত কয়েক দশকের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীব্যাপী আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এই জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর প্রতিটি দেশের উপর পড়ছে। যেমন -  ১৯৯০ এর দশকে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর গুলি পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে ১৯৯৫ সাল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। সাইবেরিয়ার বেশির ভাগ অংশের তাপমাত্রা পূর্ববর্তী শতক গুলির তুলনায় ৩ থেকে ৫  ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।  ১৮৫০ সালের পর থেকে ইউরোপের আল্পস পর্বতের অর্ধেক বরফ গলে গিয়েছে। মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্টার্কটিকায় পেঙ্গুইনের সংখ্যা কমে গেছে এবং ক্রিল জাতীয় একপ্রকার সামুদ্রিক প্রানী যাদের বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রানীরা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে তাদের পরিমানও ক্মে গেছে। 
ক্রান্তীয় অঞ্চল গুলি আরো উষ্ণ ও শুষ্ক হচ্ছে, কৃষিকাজ ব্যহত হচ্ছে ও জলের অভাব দেখা যাচ্ছে। মঙ্গোলিয়ার গোবি মরু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমান বিগত ৩০ বছর ধরে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলেও বৃষ্টিপাত পূর্বের তুলনায় অনেক কমে গেছে। 

হিমবাহের গলন - মেরু অঞ্চলে যে হিমবাহের চুড়া গুলি হাজার হাজার বছর ধরে অক্ষত অবস্থায় ছিল আজ সেই বরফ চাঁই গুলি বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে অতি দ্রুত গলিত হয়ে যাচ্ছে।মেরু অঞ্চল গুলিতে শীতকালীন বরফ সঞ্চয়ের পরিমান অনেকটা হ্রাস পেয়েছে এবং যে পুরু বরফের স্তর গুলি সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলি গ্রীষ্মের আগমনের সাথে সাথেই গলে যাচ্ছে। আন্টার্কটিকার বহু বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে থাকা বিশাল বিশাল বরফের স্তূপ গুলি আজ অতি সহজেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকার মধ্যভাগে বরফ পাতের পরিমান বৃদ্ধি পেলে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য এই দুই জায়গায় বরফের চাদর গুলি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। 

সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি - বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মেরু অঞ্চলে সঞ্চিত থাকা বরফ চূড়া গুলি অতি দ্রুত গলে যাচ্ছে, যার ফলে সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। IPCC এর মতে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্র জলের উচ্চতা ২০ থেকে ৮০ সেমি মতো বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষজন এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভয়াবহতার সৃষ্টি করছে। সমুদ্র জল পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রাথমিক প্রভাব হল উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা, ভূমিক্ষয়, সমুদ্র তরঙ্গ ও ঘূর্নিঝর জনিত জলোচ্ছ্বাসের পরিমান বৃদ্ধি। যার ফলে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র যেমন জলাভূমির সমুদ্র জলে নিমজ্জন , উপকূলীয় অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও বাসস্থানের অবলুপ্তি, ভৌমজলের মধ্যে সামুদ্রিক নোনা জলের প্রবেশ এবং কৃষিজাত জমির অভাব পরিলক্ষিত হয়।    
আগামী  এক শত বছরে সমুদ্র জলের উচ্চতা যে পরিমান বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে, সেই পরিমান উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্র মধ্যবর্তী দ্বীপ যেমন মালদ্বীপ, মার্শাল দ্বীপ যেগুলি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু সেগুলি সম্পূর্ন ভাবে সমুদ্রতলে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলির উপকূলবর্তী অঞ্চল গুলিতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে, সেই মানুষ গুলিও একটি বিরাট সমস্যার সম্মুখিন পর্যন্ত হতে পারে। 

বন্যার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি - বিশ্ব উষ্ণায়ন জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটিয়ে জলবায়ু সম্পর্কীত দূর্যোগ, যেমন - ঝড়, বন্যা প্রভৃতির পরিমান বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় পৃথিবীর প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ মানুষ মৌসুমি বায়ুর প্রভাবিত অঞ্চলে বসবাস করে আর এই মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির প্রধান কারণ সমুদ্র ও স্থলভাগের উষ্ণতার পার্থক্য। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে স্থল ও জলভাগের উষ্ণতার তারতম্য সৃষ্টি করছে আবার এই উষ্ণায়নের জন্য মৌসুমি বায়ুর জলধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

এল নিনো ও সার্দান অসিলিয়েশন - একটি গুরুত্বপূর্ন ও রহস্যময় ঘটনা হল এল নিনো, যা প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র স্রোত ও বায়ুপ্রবাহের দিক ও তীব্রতা পরিবর্তনের সাথে যুক্ত। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র জলের গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে এল নিনো আবির্ভাবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিংশ শতকের প্রথম দিকে ১০ থেকে ১৫ বছরের ব্যবধানে এল নিনোর আবির্ভাব হতো কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৩ থেকে ৫ বছরের ব্যবধানে এল নিনোর আগমন ঘটছে, শুধু তাই নয় এল নিনোর তীব্রতাও পূর্বের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি - ক্রান্তীয় অঞ্চলে আবহাওয়া গত দূর্যোগ গুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হল ঘূর্নিঝড়, যা ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্গত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত গুলি সমুদ্র ওপর সৃষ্টি হয়ে থাকে যখন সমুদ্র জলের উষ্ণতা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্র জলের তাপমাত্রা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে এছাড়া বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত হয়ে জলীয় বাষ্পের জোগানও বৃদ্ধি পেয়েছে যা ঘূর্নিঝড়ের শক্তির প্রধান উৎস। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য এই ক্রান্তীয় ঘূর্নিঝড়ের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই গতিবেগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন - ক্যারিবিয়ান সাগরে সৃষ্ট ঘূর্নিঝড় হ্যারিকেনের সংখ্যা পূর্ববর্তী বছর গুলির তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। 

মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব - বিশ্ব উষ্ণায়ন মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক ভাবে বলা যায় বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশ গুলিতে তাপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ক্রান্তীয় অঞ্চলও উষ্ণ থেকে আরো উষ্ণতর হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে এই তাপ প্রভাবের কারণে আজ সারা বিশ্ব ব্যাপী অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। উষ্ণায়নের কারণে জীবাণু ঘটিত রোগের পরিমাণও বাড়ছে। পতঙ্গ বাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এই বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। 

জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব - IPCC এর রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান সময়ে যে সব জীব বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার মূলেও রয়েছে এই বিশ্ব উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ুর পরিবর্তন। 
যেমন - আফ্রিকার পার্বত্য গরিলা, আন্দিজের ভাল্লুক, বাংলার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও সুন্দরবনের জলাভূমি বিভিন্ন প্রজাতি, মেরু ভাল্লুক, পেঙ্গুইন প্রভৃতি জীব প্রজাতি। সমুদ্রের প্রবাল প্রাচীর যা জলের উষ্ণতার পরিবর্তনের সাথে অতি স্পর্শকাতর, তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ধ্বংসের মুখে অবস্থিত। 

কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব - বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিজ উৎপাদন কে প্রভাবিত করছে, বিশেষ করে ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্গত আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার দেশ সমূহের উপর,যেখানে পূর্বে থেকে ফসলের উৎপাদন হয় খুব কম। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ফসল বলয় গুলি ক্রমশ উচ্চ অক্ষাংশীয় অঞ্চলের দিকে সরে যাচ্ছে । বিশেষ করে গম বলয় অঞ্চল গুলির উত্তরে সরণ।

তাপ প্রবাহ - আবহাওয়া জনিত দূর্যোগ গুলির মধ্যে অন্যতম হল তাপ প্রবাহ, যা পূর্বে উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশ গুলিতে গ্রীষ্মকালে মাঝে মধ্যে দেখা যেত কিন্তু আজকের সময়ে সেই তাপ প্রবাহের সংখ্যা ও স্থায়ীত্ব অনেক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তাপ প্রবাহ আজ কেবল মাত্র ক্রান্তীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশ গুলিতেও গ্রীষ্মকালে এই তাপ প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। তাপ প্রবাহের তীব্রতা বৃদ্ধির এক মাত্র কারণ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন। যার ফলে প্রতি বছর অনেক মানুষ প্রান হারাচ্ছে। 

খরার প্রবনতা বৃদ্ধি - কোন অঞ্চলে কোন নির্দিষ্ট সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমান কম হলে খরা হয়েছে বলে ধরা হয়। সাধারণত বৃষ্টিপাতের খামখেয়ালিপনার জন্য খরার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের অভাবে জলের বিভিন্ন উৎস গুলি শুকিয়ে যায়, সেই উৎস গুলি থেকে মানুষের প্রয়োজনীয় জলের ঘাটতি দেখা যায়, পুকুর, নদী এমনকি ভৌম জলের অভাব দেখা যায়। বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমান ও বন্টনে তারতম্য দেখা যাচ্ছে, কোথাও অল্প সময়ে বিপুল বৃষ্টি হচ্ছে আবার কোথাও বৃষ্টিপাতের পরিমান পূর্বের তুলনায় অনেক কমে গেছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.