সাইলেন্ট ভ্যালি বাঁচাও আন্দোলন


ভারতবর্ষের পরিবেশগত আন্দোলন গুলির মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান আন্দোলন হল সাইলেন্ট ভ্যালি বাঁচাও আন্দোলন। কেরালা রাজ্যের মালাবার উপকূল বরাবর পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণ প্রান্তে কুন্থিপুজা নদীর উপত্যকা বরাবর সাইলেন্ট ভ্যালি অঞ্চলটি অবস্থিত। সাইলেন্ট ভ্যালি অঞ্চলটি কেরালার পালাকার জেলার ৮৯৫০ হেক্টর ব্যাপী বিস্তৃত ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য দ্বারা আবৃত এবং উচ্চতা প্রায় ৩০০০ ফুট।সাইলেন্ট ভ্যালি বৃষ্টি অরণ্য ভারত তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান জীববৈচিত্র্যময় অঞ্চল। এখানে এমন কিছু উদ্ভিদ ও প্রানীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় যা পৃথিবীর অন্য কোথাও আর নেই। 

সাইলেন্ট ভ্যালি অঞ্চলে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প 
১৯৭৩ সালের এপ্রিল আসে পরিকল্পনা আয়োগ (Planning commission) কেরালার উত্তরাংশে অবস্থিত কুন্থিপুজ্জা নদীর উপর ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৪০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন সাইলেন্ট ভ্যালি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহন করে। যার ফলে জল সঞ্চয়ের জন্য নির্মিত বাঁধের ঊর্ধ্বাংশে প্রায় ৮৩০ হেক্টর বনভূমি, তার মধ্যে ৫০০ হেক্টর প্রধান ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য জলমগ্ন হয়ে পড়বে। 

এই পরিকল্পনাটি ২৪০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে যা শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা হবে, অনুন্নত  পালঘাট ও মালাপুরাম জেলার ১০,০০০ হেক্টর জমিতে জলসেচ সম্ভব হবে এবং নির্মান কার্য চলা কালীন এখান থেকে প্রায় ৩০০০ মানুষের কর্ম সংস্থান হবে। তাই মানুষ জন প্রাথমিক ভাবে এই প্রকল্প টি ভালো ভাবেই গ্রহন করেছিল কারণ এটি স্থানীয় মানুষদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়ে ছিল।

পরবর্তী সময়ে যখন এটি বোঝা যায় যে এই প্রকল্পটির ব্যস্তবায়নের ফলে উক্ত অঞ্চলের বিপুল পরিমান  উদ্ভিদ ও প্রানী জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, তখন স্থানীয় একটি সংগঠন "কেরল শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ (KSSP)" এই প্রকল্পের বিরোধীতায় এগিয়ে আসেন। কেরল শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ একটি স্থানীয় সংগঠন যা মানুষদের পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য প্রদান করে থাকে। এটি কলেজ ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত একটি সমিতি যার সাথে সমাজের প্রতিটি স্তরের গ্রামীন মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

প্রথম অবস্থায় গ্রামবাসীরা মনে করতেন এই প্রকল্পের তেমন কোন বিরূপ প্রভাব নেই এবং কেরল শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ তাদের মধ্যে ভ্রান্ত ধারনার বিকাশ ঘটাচ্ছে। তাই কেরল শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ এই প্রকল্পটির বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে গিয়ে কাঠিন্যের সম্মুখিন হন। তাই তারা জন সাধারনকে বোঝানোর জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করেন। এই পরিষদ মানুষদের বোঝায় তারা এই বাঁধ থেকে যে সুবিধা গুলি পাবে তা তো অন্য ভাবেই পাওয়া সম্ভব এবং KSSP রাজ্যের মানুষদের সচেতন করার জন্য সারা রাজ্যব্যাপী 'Save Silent Valley' উৎযাপন করে। বি.জি. ভারঘেস নামক একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক তার লেখার মাধ্যমে জনগনকে সচেতনতা করতে থাকেন। প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনগনের পদক্ষেপের কেন্দ্র বিন্দু হিসাবে কাজ করার জন্য সারা দেশে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এমনকি এই প্রকল্পটি বন্ধ করার জন্য কোন কোন সংগঠন কেরালা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন। এই আন্দোলন টি আন্তর্জাতিক সংস্থা World Wild Life Fund India এবং International Union for the Conservation of Nature and Natural Resources (IUCN) কর্তৃক সমর্থিত হয়। এ ভাবে সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলনটি আন্তর্জাতিক গুরুত্ব পেতে থাকে। 

দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের বিরোধী, সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা প্রচার ও বিভিন্ন কোর্টের আদেশের ফলে চাপে পড়ে ব্যাপারটি পর্যালোচনার জন্য তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে দশ জন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন, যার প্রধান ছিলেন এম. জি. কে. মেনন। তিনি দেখেন যে, সাইলেণ্ট ভ্যালি এমন এক অঞ্চল যা নির্বিঘ্ন, জনমানবশূন্য ও অপেক্ষাকৃত দূর্গম বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ন। এমন স্থানে জলবিদ্যুৎ নির্মান মূলক যে কোন রকম কার্যাবলি এই অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্যের হ্রাস ঘটাবে এবং পুরো এলাকার অপুরনীয় ক্ষতিসাধন করবে। যার অন্তিম ফলস্বরূপ কেন্দ্রীয় সরকার সাইলেন্ট ভ্যালি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাদ করে দেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.