মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য


সারা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জলবায়ু দেখা যায়, তারমধ্যে একটি হচ্ছে মৌসুমি জলবায়ু। মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল।

মৌসুমি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ মৌসিম থেকে যার অর্থ ঋতু অর্থাৎ যে সব অঞ্চলে ঋতু ভেদে সম্পূর্ন বিপরীত দিক থেকে বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়, সেই সব অঞ্চলে মৌসুমি জলবায়ু দেখা যায়।

অবস্থান – সাধারনত নিরক্ষরেখার উপরে ১০ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলে এই জলবায়ু দেখা যায়।

দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলিতে এই জলবায়ু দেখা যায়। যেমন – ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস প্রভৃতি দেশে। এদের মধ্যে ভারতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সব থেকে বেশি থাকায় ভারতবর্ষকে আর্দশ মৌসুমি জলবায়ুর দেশ বলা হয়।

এই অঞ্চল বা দেশ গুলি ব্যতিত পৃথিবী অন্যান্য কিছু জায়গায় স্থল ও জলভাগের উষ্ণতার পার্থক্য জনিত কারণে এই রকম ঋতু ভিত্তিক বায়ুর বিপরীত প্রবাহ লক্ষ্য করা গেলেও মৌসুমি জলবায়ুর সব বৈশিষ্ট্য তেমন ভাবে দেখা যায় না বলে এই অঞ্চল গুলিকে ছদ্ম মৌসুমি জলবায়ুর দেশ বলা হয়।
যেমন – অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাংশের কুইন্সল্যান্ডে, আফ্রিকার মোজাম্বিক ও মাদাগাস্কার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা প্রভৃতি অঞ্চল।

মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য
  • ঋতুবৈচিত্র্য – মৌসুমি জলবায়ুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঋতু বৈচিত্র্য। অর্থাৎ মৌসুমি জলবায়ু অধ্যুষিত অঞ্চল গুলিতে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
  • বায়ুপ্রবাহ – এই মৌসুমি জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শীত ও গ্রীষ্মকালে বিপরীত মুখী বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতি। যা মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত। এই মৌসুমি বায়ুর জন্য এই মৌসুমি জলবায়ুর সৃষ্টি হয়েছে। গ্রীষ্মকালে ক্রান্তীয় সমুদ্রের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে স্থলভাগের নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয় তাকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বলে এবং শীতকালে উত্তর -পূর্ব দিক থেকে যে বিপরীত মুখী বায়ু প্রবাহিত হয় তাকে উত্তর – পূর্ব মৌসুমি বায়ু বলে।
  • উষ্ণতা – মৌসুমি বায়ুর অধ্যুষিত অঞ্চল গুলি ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় গ্রীষ্মকালে সূর্য কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর লম্ব ভাবে কিরন দেয় বলে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা খুব বেশি হয়। গরমকালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়। শীতকালীন গড় তাপমাত্রা থাকে ১০ ডিগ্রি থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এই জলবায়ু অঞ্চলে শীত কাল ব্যতীত  অন্যান্য সব ঋতুই উষ্ণ।
  • বৃষ্টিপাত – ভারতে বেশির ভাগ বৃষ্টি বর্ষাকালে দক্ষিন – পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবেই হয়ে থাকে। এই জলবায়ু অঞ্চলে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ১৫০ থেকে ২০০ সেমি। শীতকালে তেমন একটা বৃষ্টিপাত হয় না।
  • বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন – মৌসুমি বায়ুর প্রভাবিত অঞ্চলের সর্বত্র সমান বৃষ্টিপাত হয় না। কোন কোন অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে আবার কোথাও বৃষ্টিপাতের পরিমান হয় যত সামান্য।আবার কোন কোন বছর মৌসুমি বায়ুর আগমন কোন কারণ বশত বাধা প্রাপ্ত হলে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
  • আর্দ্র গ্রীষ্মকাল ও শুষ্ক শীতকাল – গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত দক্ষিন-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয় বলে গ্রীষ্মকাল আর্দ্র প্রকৃতি হয়। কিন্তু শীতকালে স্থলভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুতে তেমন জলীয় বাষ্প থাকে না বলে শীতকাল শীতল ও শুষ্ক প্রকৃতির হয়।
  • স্থানীয় বায়ুর অস্তিত্ব – মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চল গুলি গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা জনিত কারণে নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে স্থানীয় ভাবে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়ে থাকে । যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকালে স্থানীয় ভাবে ঝরের সৃষ্টি হয় তা নর’ওয়েস্টার বা কালবৈশাখী এবং দক্ষিন ভারতে আম্রবৃষ্টি নামে পরিচিত । আবার গরমকালে ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে প্রচণ্ড গরম বাতাস প্রবাহিত হয়, তা লু ও আঁধি নামে পরিচিত। এছাড়া ভারতের পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর থেকে আগত পশ্চিমী ঝঞ্ঝার ফলে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
  • বায়ুচাপের পরিবর্তন – মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মকালে স্থলভাগ ও জলভাগের মধ্যে বায়ুচাপের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যা মৌসুমি বায়ু প্রবাহে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। শীতকালে মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের সমুদ্রে নিম্নচাপ ও স্থলে উচ্চচাপ অবস্থান করে এবং গ্রীষ্ম কালে এর বিপরীত অবস্থা দেখা যায়।
  • ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত – এই জলবায়ু অঞ্চল টি ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত এবং এই ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্র গুলি গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত উষ্ণ হয়ে নিম্নচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে ঘূর্নবাতের প্রাদুর্ভাব ঘটায় বলে এই জলবায়ু অঞ্চল গুলি ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়।  

মৌসুমি বিস্ফোরণ – কোন কোন বছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারত তথা অন্যান্য মৌসুমি বায়ুর প্রভাবিত অঞ্চল গুলিতে প্রচুর পরিমান বৃষ্টিপাত হয়, যা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি। ফল স্বরূপ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একেই মৌসুমি বিস্ফোরন বলে। সাধারণত যে যে বছর প্রশান্ত মহাসাগরের এল নিনো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না সে সে বছর দক্ষিন পশ্চিম মৌসুমি বায়ু যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়।

মৌসুমি বায়ুর ছেদ বা বিরাম – দক্ষিন-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু আরব সাগরীয় শাখা ভারতে প্রবেশ করে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু এই বৃষ্টি সব সময় একই রকম হয় না, কখনো কখনো ৭ থেকে ১৫ দিন বিরাম নেওয়ার পর আবার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। একেই মৌসুমি বায়ুর ছেদ বা বিরাম বলা হয়।

👉 মৌসুমি জলবায়ু ও ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর পার্থক্য - Click Here

👉 মৌসুমী বায়ু ভারতে আসার কারণ - click here

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.