বৃষ্টিপাতের শ্রেণীবিভাগ


আকাশে ভাসমান মেঘ স্থিত জলকনা যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন শক্তির প্রভাবে জলবিন্দু রূপে পৃথিবীপৃষ্ঠে ঝরে পরে তখন তাকে বৃষ্টিপাত বলা হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বৃষ্টিপাতকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। বৃষ্টিপাতের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল ।

বৃষ্টিপাত কাকে বলে 

ভূ-পৃষ্ঠীয় জলভাগ থেকে সৃষ্ট জলীয় বাষ্প বায়ুর সংস্পর্শে এসে হালকা হয়ে উপরে উঠে ক্রমশ সম্পৃক্ত হয়ে অতিরিক্ত শীতলতার সংস্পর্শে এসে ঘনীভূত হয়ে জলকনায় পরিনত হলে তা ফোঁটা ফোঁটা আকারে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে, তখন তাকে বৃষ্টিপাত বলে। 

বৃষ্টিপাত কত প্রকার ও কী কী 

জলীয় বাষ্পপূর্ন বায়ুর ওপরে ওঠার প্রবনতা, তার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বৃষ্টিপাতকে তিনভাগে ভাগ করা হয়  - ক) পরিচলন বৃষ্টিপাত  খ) শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত গ) ঘূর্নবাত বৃষ্টিপাত 

বৃষ্টিপাতের কারণ 

জলীয় বাষ্প অতিরিক্ত শীতলতার সংস্পর্শে এসে ঘনীভূত হয়ে মেঘরূপে আকাশে ভেসে বেরায়, কিন্তু সব মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টিপাত হওয়ার জন্য দুটি বিষয়ের প্রয়োজন হয় - জলীয় বাষ্পপূর্ন বায়ুর উপস্থিতি এবং এই জলীয় বাষ্প কে ধারন করার জন্য় বাতাসে ভাসমান ধূলিকনার উপস্থিতি। এই দুটি কারনের সাথে সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কারণ হল বায়ুর ঊর্ধ্বগমন তথা বায়ুর ওপরে ওঠার প্রবনতা। 

জলীয় বাষ্প পূর্ন আর্দ্র বায়ু ক্রমশ হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায় এবং ওপরে উঠে শীতলতার সংস্পর্শে এসে ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকনায় পরিনত হয়ে  বাতাসে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র ধূলিকনা কে আশ্রয় করে মেঘ রূপে ভেসে বেরাতে থাকে। এই মেঘস্থিত জলকনা গুলি পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে ক্রমশ বড়ো জলকনায় পরিনত হতে থাকে এবং এক সময়  এই জলকনা গুলি ভেসে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন শক্তির প্রভাবে জলবিন্দু রূপে ঝরে পরে। এইভাবেই সাধারণত বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। 
https://www.bhugolhelp.com/2020/10/classification-of-rainfall.html

পরিচলন বৃষ্টিপাত কাকে বলে 

পৃথিবীর যে সব অঞ্চলে জলভাগের পরিমান বেশি, সেই সব অঞ্চলে দিনের বেলায় প্রখর সূর্যতাপে জলীয় বাষ্প পূর্ন বায়ু পরিচলন পদ্ধতিতে হালকা হয়ে ওপরে উঠে প্রসারিত ও শীতল প্রথমে মেঘ এবং পরে বৃষ্টিরূপে নিচে নেমে আসে । এই ধরণের বৃষ্টিপাত কে পরিচলন বৃষ্টিপাত বলা হয়। 

নিরক্ষীয় অঞ্চলে জলভাগের পরিমান বেশি থাকায় এবং এখানে সূর্য সারা বছর লম্ব ভাবে কিরন দেয় বলে, নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রতিদিন বিকেলের দিকে পরিচলন প্রক্রিয়ায় বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ।
 
পরিচলন বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য 

➤ পরিচলন বৃষ্টিপাত সৃষ্টির জন্য সাধারনত প্রচুর জলভাগের এবং প্রবল সূর্য কিরনের প্রয়োজন হয়। তাই বলা যেতে পারে পরিচলন বৃষ্টি এক ধরণের উষ্ণ আবহমন্ডলীয় ক্রিয়াকলাপ। 

➤ পরিচলন বৃষ্টিপাতের সাথে মাঝে মাঝে স্থানীয় ভাবে ঝড়, বর্জ্রবিদ্যুৎ আবার কখনো কখনো শিলাবৃষ্টিও হয়ে থাকে। 

➤ নিম্ন অক্ষাংশীয় জলবায়ু অঞ্চলে  পরিচলন বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে। 

এই পরিচলন বৃষ্টিপাত নিরক্ষীয় অঞ্চলে 4 O'clock Rain  নামে পরিচিত। 

➤ সাধারনত কিউমুলোনিম্বাস মেঘ থেকে এই ধরণের বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। 

শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত কাকে বলে 

জলীয় বাষ্প পূর্ন আর্দ্র বায়ু কোন উঁচু পর্বতে বাঁধা পেয়ে পর্বতের গাঁ বেয়ে ওপরে উঠে ওপরের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে ঘনীভূত পর্বতের প্রতিবাত ঢালে যে বৃষ্টিপাত ঘটায় তাকে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত বলে। এই ধরণের বৃষ্টিপাত সৃষ্টিতে শৈল অর্থাৎ পর্বত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে বলে। একে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত বলা হয়ে থাকে। 

বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল - পর্বতের প্রতিবাত ঢালে বৃষ্টিপাত হওয়ার পর সেই বায়ু যখন পর্বতের অপর পারে অর্থাৎ অনুবাত ঢালে গিয়ে পৌঁছায়, তখন সে বায়ুতে আর আগের মতো জলীয় বাষ্প থাকে না বলে সেই রকম বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। এই রূপ অঞ্চল কে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলা হয়। 

যেমন - ভারতের মেঘালয়ের শিলং পর্বতের প্রতিবাত ঢালে অবস্থিত চেরাপুঞ্জির মৌসিনরাম অঞ্চলে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমানে  শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত হয় কিন্তু শিলং পর্বতের বিপরীত ঢালে তেমন কোন বৃষ্টিপাত হয় না। 

একই ভাবে মৌসুমি বায়ু কেরালা দিয়ে ভারতে যখন প্রথম প্রবেশ করে তখন এই পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলে বাঁধা পেয়ে পশ্চিম ঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে শৈলোৎক্ষেপ প্রক্রিয়ায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় কিন্তু পূর্ব ঢালে সেই রকম বৃষ্টিপাত হয় না বলে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। 

বৃষ্টিপাতের  বৈপরীত্য কী - শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাতের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বৃষ্টিপাতের বৈপরীত্য। শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে জলীয় বাষ্প পূর্ন বায়ু যখন পর্বতে বাঁধা পেয়ে পর্বতের গাঁ বেয়ে ওপরে ওঠে, তখন এই বায়ুপুঞ্জ পর্বতের চূড়ায় পৌছানোর আগেই ঘণীভূত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই বৃষ্টিপাত একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা অবধিই হয়ে থাকে তারপর ক্রমশ কমতে থাকে। তাই এই বায়ু যখন পর্বতের শীর্ষে এসে পৌঁছায় বায়ুপুঞ্জে জলীয় বাষ্প আর থাকে না বলে বৃষ্টিপাতের পরিমান অনেক কমে যায় অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে উচ্চতার বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃষ্টিপাতের পরিমান না বেড়ে কমে যাচ্ছে। এই ঘটনাকেই বলা হয় বৃষ্টিপাতের বৈপরীত্য । 

সীমান্ত বৃষ্টিপাত কাকে বলে 

নাতিশীতোষ্ণ বা মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে পরস্পরের বিপরীত দিকে প্রবাহিত দুটি ভিন্ন ধর্ম বিশিষ্ট বায়ুপুঞ্জ পরস্পর মিলিত হলে উভয় বায়ুর মিলন স্থলে অস্থিরতা বা আলোড়নের সৃষ্টি হয়।এই মিলন স্থল বরাবর উষ্ণ আর্দ্র হালকা বায়ুপুঞ্জ শীতল ভারী বায়ুপুঞ্জের গাঁ ঘেসে ওপরে উঠে যায়। ওপরে উঠে এই বায়ু ঘনীভূত হয়ে নিম্বোস্ট্যাটাস মেঘের সৃষ্টি করে এবং এই মেঘ থেকে এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। একে সীমান্ত বৃষ্টিপাত বলে। উষ্ণ সীমান্ত বরাবর সাধারণত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে এবং এই ধরণের বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময় ধরে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে হয়ে থাকে। কিন্তু শীতল সীমান্তের সাথে সম্পর্কীত বৃষ্টিপাত সাধারনত বর্জ্রবিদ্যুৎ সহ হয়ে থাকে এবং খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়। 

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় শীতকালে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা এই সীমান্ত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়ে থাকে। 

ঘূর্নবাত জনিত বৃষ্টিপাত 

ক্রান্তীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্নিঝরের সময় যে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে তাকে ঘূর্নবাত জনিত বৃষ্টিপাত বলে। সাধারনত ক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্য তাপ জনিত কারণে কোন স্থানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে ওই নিম্নচাপ স্থানের বায়ু হালকা হয়ে ওপরে উঠে গেলে যে শূন্য স্থানের সৃষ্টি হয় তা পূরন করার জন্য পার্শ্ববর্তী উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে শীতল বায়ু সেই নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে কুণ্ডলীর আকারে ঘুরতে ঘুরতে প্রবল বেগে ওপরে উঠে শীতল ও ঘনিভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই ধরণের বৃষ্টিপাত কে ঘূর্নবাত জনিত বৃষ্টিপাত  বলে। এই ধরণের বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে কিউমুলোনিম্বাস মেঘের সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। 

গাছ কীভাবে বৃষ্টিপাত হতে সাহায্য করে 

বৃষ্টিপাতের অন্যান্য নিয়ন্ত্রকের মতো গাছ বা সবুজ উদ্ভিদও বৃষ্টিপাত হতে যথেষ্ট সাহায্য করে । যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা এখন অনেকেই দেখতে বা বুঝতে পারছি। সারা পৃথিবী ব্যাপী প্রচুর পরিমানে বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমান ও তার বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যে জায়গা গুলিতে আগে বৃষ্টিপাত হতো  এখন সেখানে গাছের অভাবে আর আগের মতো তেমন বৃষ্টিপাত হয় না। তাহলে এখান থেকে আমরা বুঝতে পারছি গাছ পরোক্ষ ভাবে বৃষ্টিপাত হতে সাহায্য করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে গাছ কীভাবে বৃষ্টিপাত হতে সাহায্য করছে।

সবুজ উদ্ভিদ তাদের শিকড়ের মাধ্যমে  মাটি থেকে যে জল শোষন করে, তার কিছু অংশ তাদের শারীর বৃত্তীয় কাজে ব্যবহৃত হওয়ার পর যে অবশিষ্ট জল থাকে তা সবুজ উদ্ভিদ তাদের পাতায় অবস্থিত পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বাইরে ছেড়ে দেয়। এই প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বাইরে উন্মুক্ত জলীয় বাষ্প বাতাসে জলীয় বাষ্পের জোগান বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাত হতে সাহায্য করে। তাই ঘন বনভূমি অঞ্চল গুলিতে অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। 
 

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.