ভারতের লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র

পৃথিবী তথা ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি শিল্প হল এই লৌহ ইস্পাত শিল্প। অন্য যে কোন শিল্প গড়ে তোলার জন্য লৌহ ইস্পাত শিল্পের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ লৌহ ইস্পাত শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অন্য শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য করে । তাই লৌহ ইস্পাত শিল্পকে সকল শিল্পের মেরুদণ্ড বলা হয়। তাই স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ভারতেও এই লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটতে শুরু করে এবং স্বাধীনতার পরের দেশের বর্ধিত চাহিদাকে পূরণ করার জন্য বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেশ কয়েকটি বৃহৎ আকারে আধুনিক লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বর্তমানে ভারতে ১০ টি বৃহৎ লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র আছে।
প্রধান প্রধান লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র গুলি হল - পশ্চিমবঙ্গের দূর্গাপুর ও কুলটি-বার্নপুর; ঝাড়খণ্ডের জামসেদপুর ও বোকারো; ছত্তিসগড়ের ভিলাই,  ওড়িশার রৌরকেল্লা, অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম, কর্নাটকের ভদ্রাবতী ও বিজয়নগর এবং তামিলনাড়ুর সালেম । এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র গুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ননা করা হল । 


টাটা আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানী [TISCO]  

ভারতের প্রথম আধুনিক ও বৃহৎ আকারে লৌহ ইস্পাত শিল্পের সুচনা হয় জামসেদজি টাটার হাত ধরে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার অন্তর্গত সূর্বনরেখা ও খরকাই নদীর সংযোগস্থলে সাকচি অঞ্চলে ১৯০৭ সালে এবং উৎপাদন শুরু হয় ১৯১১ সাল থেকে। 

TISCO ভারতের একমাত্র বেসরকারী লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র। বর্তমানে সাকচি অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে জামসেদজি টাটার নাম অনুসারে জামসেদপুর নাম রাখা হয়েছে। 

এই শিল্প কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় লৌহ আকরিক ওড়িশার গুরুমহিষানী, বাদামপাহাড়, কেওনঝড়, মযূরভঞ্জ এবং ঝাড়খণ্ডের নোয়ামুন্ডি ও গুয়া থেকে সুলভে সংগ্রহ করা হয়।  উন্নত মানের কয়লা ঝরিয়ার কয়লা খনি থেকে পাওয়া যায়, যা কয়লার চাহিদা পূরণ করে। 


ইন্ডিয়ান  আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানী [IISCO] 

স্বাধীনতার পূর্বে গড়ে ওঠা ভারতের দ্বিতীয় লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটির নাম হল IISCO, যা পশ্চিমবঙ্গের কুলটি ও বার্নপুর অঞ্চলে দামোদর নদীর তীরে ১৯১৯ সালে গড়ে ওঠে। বর্তমানে  এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা SAIL এর অন্তর্গত। 

IISCO এর অধীনে তিনটি লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র রয়েছে - ১. হিরাপুর  ২. কুলটি এবং  ৩. বার্নপুর 

কুলটি ও বার্নপুর লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি ঝাড়খণ্ডের গুয়া ও ময়ূরভঞ্জ থেকে সংগৃহীত আকরিক লোহা এবং পশ্চিমবঙ্গের রানিগঞ্জ ও  ঝাড়খণ্ডের ঝরিয়া কয়লা খনি থেকে উন্নত মানের কয়লা সংগ্রহ করে লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে। 


বিশ্বেশ্বরায়া আয়রন এন্ড স্টিল লিমিটেড [VISL] 

বিশ্বেশ্বরায়া লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি কর্নাটকের ভদ্রাবতীতে ভদ্রা নদীর তীরে ১৯২৩ সালে গড়ে ওঠে। 
কর্নাটকের বাবাবুদান পাহাড়ে প্রাপ্ত লৌহ আকরিক এই শিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই অঞ্চলে কয়লা তেমন পাওয়া যায় না বলে নিকটবর্তী বনভূমি অঞ্চলের কাঠ এই শিল্পে জ্বালানীর চাহিদা পূরন করে। 

স্বাধীনতার পরে লৌহ ইস্পাতের বাড়তি চাহিদাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেশ কয়েকটি লৌহ ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয় এবং সেই মতো বেশ কয়েকটি লৌহ ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলা হয়। 


দূর্গাপুর লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র  

১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দূর্গাপুরে দামোদর নদের তীরে ভারতের প্রথম সংকর ইস্পাত তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়।  

নিকটবর্তী আসানসোল ও রানিগঞ্জের কয়লা খনি এবং ওড়িশা ও ঝারখণ্ড থেকে প্রাপ্ত লৌহ আকরিকের ওপর ভিত্তি করে এই দূর্গাপুর লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। 


ভিলাই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র 

১৯৬০ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ছত্তিশগড়ের দ্রুগ  জেলায় SAIL অধীনস্থ এই ভিলাই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। ভিলাই বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম এবং এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র। ভিলাই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি রাশিয়া দেশের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয়। 

নিকটবর্তী দাল্লিরাজহারা ও অন্যান্য খনির লৌহ আকরিক এবং স্থানীয় কোরবা কয়লা খনি ও পার্শ্ববর্তী ঝরিয়া ও রানীগঞ্জ কয়লা খনি থেকে প্রাপ্ত উৎকৃষ্ট কয়লা এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রের বিকাশে সাহায্য করেছে। 


রৌরকেল্লা লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র 

ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ১৯৫৬ সালে রৌরকেল্লা লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র টি গড়ে ওঠে। রৌরকেল্লা লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি জার্মানি দেশের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে। এই শিল্প কেন্দ্রটিও SAIL এর অধীনে রয়েছে।

ওড়িশা ভারতের অন্যতম খনিজ সমৃদ্ধ রাজ্য হওয়ায় এখানে প্রচুর লৌহ আকরিক সঞ্চিত রয়েছে যা এই লৌহ ইস্পাত শিল্প গড়ে তুলতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। 

কেওনঝড়, ময়ুরভঞ্জ থেকে উত্তোলিত লৌহ আকরিক এবং তালচের, ঝরিয়া ও রানিগঞ্জের কয়লা এই শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরন করে। এছাড়া অন্যান্য খনিজ সম্পদ যেমন - চুনাপাথর ও ডলোমাইট, ম্যাঙ্গানিজ , পারাদ্বীপ ও কলকাতা বন্দরের নৈকট্য এই শিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। 


বোকারো লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র 

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১৯৭২ সালে রাশিয়ার সহযোগিতায় বর্তমান ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলায় দামোদর নদীর তীরে এই ইস্পাত কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। বর্তমানে এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র। 

নিকটবর্তী কিরিবুরু ও নোয়ামুন্ডী অঞ্চলের আকরিক লোহা এবং বোকারো কয়লা খনি অঞ্চলের কয়লা, ডালটনগঞ্জের চুনাপাথর, ছত্তিশগড়ের ম্যাঙ্গানিজ ও ডলোমাইটের সাহায্যে এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। 


বিশাখাপত্তনম লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র 

ভারতের একমাত্র বন্দর ভিত্তিক লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি হল অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম। ১৯৯২ সালে ভারতের বৃহত্তম বাতচুল্লিতে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এই ইস্পাত কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। 

অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুল, খাম্মাম এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা থেকে আমদানি করা লৌহ আকরিক ও কয়লার ওপর নির্ভর করে এই লৌহ ইস্পাত শিল্প টি গড়ে তোলা হয়।বিশাখাপত্তনম বন্দরের অবস্থান এই ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। 


সালেম লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র 

তামিলনাড়ু রাজ্যে দেশের বৃহত্তম সালেম সংকর ইস্পাত কারখানা টি গড়ে তোলা হয়। 

সালেম ও তিরুচিরাপল্লী আকরিক লোহা, চুনাপাথর, ম্যাঙ্গানিজ, নেভেলির তাপবিদ্যুৎ ও মেত্তুর জলবিদ্যুৎ, চেন্নাই বন্দরের নৈকট্য প্রভৃতি কারনের সহজলভ্যতার জন্য এই ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছে। 


বিজয়নগর লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র 

 কর্নাটকের বেলারি জেলার হস্পেট অঞ্চলে এই লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। 

হসপেট অঞ্চলে লৌহ আকরিক এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য গুলি থেকে আমদানি কৃত কয়লা, চুনাপাথর, ডলোমাইট, চুনাপাথর, ম্যাঙ্গানিজ ও তুঙ্গভদ্রা জলপ্রপাত থেকে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ এই শিল্পের বিকাশে সাহায্য করেছে। 



কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.