ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে ভারতের শিলা সমূহ

ভূতাত্ত্বিক গঠন কোনোদেশের কৃষি, শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ হিসাবে ইন্দো গঙ্গা সমভূমির ভূতাত্ত্বিক গঠনের কথা বলা যায়, যেখানে অত্যাধিক পলি সঞ্চয়ের ফলে ভূমিভাগ গঠিত হয়েছে বলে কৃষি কাজে এই অঞ্চল সর্বাপেক্ষা উন্নত। আবার অন্যদিকে উপদ্বীপীয় ভারতের দক্ষিণ দিকের মালভূমি অঞ্চল ও অন্যান্য অঞ্চল বন্ধুর প্রকৃতির হওয়ার কারণে কৃষিকাজে অনুন্নত। 
ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে ভারতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা - 

১] উপদ্বীপীয় ভারত - সমগ্র দক্ষিনাত্য মালভূমি এবং এই মালভূমির প্রসারিত অংশ মেঘালয় মালভূমি এবং  কচ্ছ-কাথিয়াবার অঞ্চল। 
২] অতিরিক্ত উপদ্বীপীয় ভারত - হিমালয় এবং আন্দামান অ নিকোবর অঞ্চল 
৩] ইন্দো - গঙ্গা সমভূমি 

ভারতবর্ষের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস আলোচনা করলে এখানে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধরণের শিলাসমূহ পাওয়া যায়। Sir T. Holland ভারতবর্ষকে চারটি প্রধান শিলা প্রনালীতে ভাগ করেছেন।
A] The Archaean rock system 
B] The Purana rock system 
C] The Dravidian rock system
D] The Aryan rock system

ভারতবর্ষে প্রাপ্ত শিলা সঙ্ঘ গুলির মধ্যে Dharwar, Deccan এবং Tertiary সময়ের শিলাসমূহ উল্লেখযোগ্য। নিম্নে এগুলির বিস্তারিত বর্ননা করা হল। 

ধারওয়ার সিস্টেম - এই শিলাসমূহ তৈরি হয়েছিল ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের আগে। ভারতবর্ষে এই শিলাসমূহের নামকরন করা হয় কর্নাটকের ধারওয়ার জেলার নাম অনুসারে। যেখানে এই শিলা প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। এই যুগের শিলাসমূহের মধ্যে রূপান্তরিত শিলাসমূহের পরিমান বেশি। 
বিখ্যাত ভূতাত্ত্বিক Wadia মত অনুসারে - "The Dharwar system is the most ancient metamorphosed sedimentary rock system of India, as old as and in some cases older than the basement gneisses and schists." পূর্বেকার Archaean rock system এর নিস্ট ও সিস্ট শিলা সমূহের ক্ষয়ীভবনের ফলে যে শিলা সমূহ তৈরি হয়, সেই সমস্ত শিলা গুলিই হল Dharwar যুগের শিলা।  এছাড়া কিছু আগ্নেয় শিলার রূপান্তরের কারণে ধারওয়ার শিলা তৈরি হয় এবং এই রূপান্তরিত শিলাসমূহের পূর্বেকার প্রাচীন আগ্নেয় শিলাসমূহ থেকে সম্পূর্ন ভিন্নধর্মী। ধারওয়ার যুগের প্রধান প্রধান শিলাসমূহ হল - হর্নব্লেড, শিস্ট, কোয়ার্টজাইট, ফিলাইট, শ্লেট, চুনাপাথর ও ডলোমাইট। 

ধারওয়ার যুগের শিলাসমূহ প্রধানত তিনটি সময়ে রূপান্তরিত হয়ে তৈরি হয় - 
প্রথম অবস্থায় -  ৩১০০ মিলিয়ান বছর পূর্বে 
দ্বিতীয় অবস্থায় - ২৩০০ মিলিয়ান বছর পূর্বে
তৃতীয় অবস্থায় - ১০০০ মিলিয়ান বছর পূর্বে 

বন্টন -  ধারওয়ার যুগের শিলা ভারতের ৪ টি অঞ্চলে পাওয়া যায়। 

১) দক্ষিনের  দাক্ষিনাত্য অঞ্চলে - দক্ষিনের দাক্ষিনাত্য অঞ্চলের মধ্যে কর্নাটক রাজ্যের ধারওয়ার অঞ্চলই প্রধান। Bruce foot প্রথম এই অঞ্চলের শিলার ভিত্তিতে এই নামকরন করেন। এই ধরনের শিলা কর্নাটকের ধারওয়ার ও বেলারি অঞ্চলে প্রায় ১৫৫৪০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে। যা আবার নীলগিরি, মাদুরাই ও শ্রীলঙ্কাতে পাওয়া যায়। এই যুগের শিলা আবার অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদ, নেল্লোর, কুর্নুল ও তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লী প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া যায়। 

২) পূর্ব ও মধ্য ভারতের মালভূমি অঞ্চলে - এই বিস্তৃত অঞ্চলটি ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, হাজারিবাগ; ছত্তিসগড়ের বাস্তার, দান্তেবারা, কাঙ্কের; ওড়িশার সুন্দরগড়, কেওনঝর জুড়ে অবস্থিত। 

৩) উত্তর - পশ্চিম ভারতে - এই জাতীয় শিলা উত্তর - পশ্চিম অঞ্চলেরর রাজস্থান, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায়। এছাড়া আরাবল্লী পর্বতের জয়পুর ও পালানপুর অঞ্চলে দেখা যায়। 

৪) হিমালয় অঞ্চলে - এই শিলা হিমালয় অঞ্চলের পূর্ব ও উত্তর ভাগে এবং মেঘালয় অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। 

অর্থনৈতিক গুরুত্ব - ধারওয়ার যুগের শিলা সমুহ অর্থনৈতিক কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ন কারণ এখানে বিভিন্ন ধরণের খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। বিভিন্ন খনিজের মধ্যে লৌহ আকরিক, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, সোনা, কোয়াটজাইট, শ্লেট, অভ্র ইত্যাদি পাওয়া যায়। 

ডেকান ট্রাপ - ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষ পর্যায় থেকে ইয়োসিন যুগের শুরু পর্যন্ত উপদ্বীপীয় ভারতের দক্ষিণ অংশে ক্রমাগত অগ্ন্যুৎগমনের ফলে যে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে আগ্নেয় শিলা গঠিত মালভূমি তৈরি হয়, সেটি দাক্ষিনাত্য শিলা নামে পরিচিত। প্রায় ১০ লক্ষ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে বাসল্ট লাভা সঞ্চয়ের ফলে গঠিত হয়েছে । বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে লাভা সঞ্চয়ের ফলে গঠিত হয়েছে বলে, এটি দেখতে অনেকটা সিঁড়ির মতো, তাই একে ডেকান ট্রাপ বলে। লাভা স্তর গুলি কয়েক মিটার থেকে ৩৬ মিটার পর্যন্ত পুরু। বহু যুগ ধরে নগ্নীভবনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত ডেকান ট্রাপ তার প্রকৃত আয়তনের প্রায় অর্ধেক ক্ষয় প্রাপ্ত হয়েছে এবং বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ বর্গকিমি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। 

ডেকান ট্রাপের গভীরতা - ডেকানট্রাপের গভীরতা বা পুরুত্ব সর্বত্র সমান নয়। মুম্বাই উপকূল বরাবর গভীরতা প্রায় ৩০০০ মিটার এবং পূর্ব দিকে ক্রমশ কমতে থাকে। কচ্ছ অঞ্চলে প্রায় ৮০০ মিটার এবং কর্নাটকে ১৫০ মিটার পুরু। 

গঠন - মূলত তরল লাভা দ্রুত শীতল হয়ে এই শিলা গঠিত হয়েছে বলে কেলাসন এর মূখ্য বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন প্রকার সমজাতীয় ব্যাসল্ট শিলা দ্বারা এটি গঠিত। এই শিলা ক্ষয়ীভবনের ফলে গাঢ় বাদামি রঙের রেগুর মৃত্তিকা গঠিত হয়েছে। এই শিলা গুলি তিনটি পর্যায়ে গঠিত হয়েছে। যথা - 

The Lower Trap -  এই স্তরটি ১৫০ মিটার পুরু। এই স্তর মূলত আগ্নেয়গিরির লাভা, ছাই এবং ভস্মীভূত পদার্থ দ্বারা গঠিত। 
The Middle Trap -  এই স্তরটি প্রায় ১২০০ মিটার পুরু। এটি প্রধানত লাভা এবং ছাই দ্বারা গঠিত। মধ্যভারত, মালওয়া প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায়। 
The Upper Trap - এই স্তরটি প্রায় ৪৫০ মিটার চওড়া। কেবলমাত্র লাভা দ্বারা গঠিত। কোথাও কোথাও স্তরীভূত শিলার মিশ্রন রয়েছে। মহারাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র প্রভৃতি স্থানে এটি দেখা যায়। 

বন্টন - গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, মালওয়ার মালভূমি, কর্নাটক প্রভৃতি অঞ্চলে এই শিলা অধিক পরিমানে পাওয়া যায়। এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ, দক্ষিণ বিহার প্রভৃতি অঞ্চলেও এই শিলা পাওয়া যায়। 

অর্থনৈতিক গুরুত্ব - দাক্ষিনাত্য মালভূমির ব্যাসল্ট শিলা রাস্তা ও বাড়িঘর নির্মানে প্রচুর পরিমানে ব্যবহৃত হয়। এই সমস্ত অঞ্চল ম্যাগনেটাইট জাতীয় লৌহ আকরিকের উল্লেখযোগ্য উৎস। এছাড়া কতগুলি স্থানে বক্সাইড পাওয়া যায়। ব্যাসল্ট শিলা ক্ষয়ীভবনের ফলে গঠিত রেগুর মৃত্তিকা তুলো উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। 

টার্সিয়ারি যুগের শিলা সমূহ 
ভারতের ভূতাত্ত্বিক গঠনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, টার্সিয়ারি যুগ ভারতীয় উপমহাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময়। কারণ এইসময় ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান ভূমিরূপ গুলি গঠিত হয়। যার মধ্যে দুটি ভূতাত্ত্বিক ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যথা - 
ক) গন্ডোয়ানাল্যান্ডের সর্বশেষ বিভাজন ও ক্ষয়ীভবন এবং ক্ষয়ীভূত পদার্থ সমূহের সমুদ্র তলদেশে সঞ্চয়। 
খ) টেথিস নামক অগভীর সমুদ্রখাতে সঞ্চিত পলিরাশির প্রবল ভূ-আন্দোলনের ফলে ভাঁজ যুক্ত হয়ে উত্তাপন এবং হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি। 

গন্ডোয়ানাল্যান্ডের বিভাজন এবং হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি - যদিও সঠিক ভাবে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের বিভাজনের সময়কাল নির্দিষ্ট করা যায় নি তবুও ভূতাত্ত্বিক গনের মতে ত্রিয়াসিক যুগের (১৭০-১৮০মিলিয়ন) শেষ সময় থেকেই এতে ফাটল সৃষ্টি হয় এবং ইয়োসিন যুগের শেষ অবধি এই প্রক্রিয়া স্থায়ী হয়। এই বিভাজিত বস্তু সমূহ ক্ষয়জাত পদার্থের সাথে টেথিস মহীখাতে সঞ্চিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে ভারতীয় পাত ও এশিয়া পাতের চলনের ফলে টেথিস মহীখাতে সঞ্চিত পলিরাশি তে চাপ পড়ে ভাঁজের ফলে হিমালয় পর্বত গঠিত হয়। মধ্য ইয়োসিন সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। 
বিখ্যাত ভূতাত্ত্বিক ওয়াদিয়ার মতে হিমালয় পর্বতের উৎপত্তি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। যথা - 
১. প্রথম পর্যায় অলিগোসিন যুগে 
২. দ্বিতীয় পর্যায় ইয়োসিন ও মধ্য ইয়োসিন যুগে 
৩. শেষ পর্যায় পিলিওসিন যুগে 

টার্সিয়ারি যুগের শিলা সমূহের বণ্টন - টার্সিয়ারি যুগের শিলাসমূহ পাকিস্তানের সিন্ধু বালিচিস্তান থেকে হিমালয় পর্বতমালাসহ আসাম, মায়ানমারের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মূলত সামুদ্রিক সঞ্চয়ের ফলেই এগুলির সৃষ্টি। 

টার্সিয়ারি যুগের শিলা সমূহ কে মূলত তিনটি সময়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা - 

ইয়োসিন প্রনালী - এটি মূলত জম্বু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে ও গুজরাটের সুরাট, কচ্ছ ও ব্রোচ অঞ্চলে এই শিলার সঞ্চয় দেখা যায়। এই সময় মূলত চুনাপাথর ও কয়লা সমন্বিত স্তরীভূত শিলা গঠিত হয়। জয়ন্তিয়া, দক্ষিণ ও পূর্ব মেঘালয় মালভূমিতে যার অবস্থান রয়েছে। এছাড়া আসাম উপত্যকার কয়লা সমূহ এই সময় সঞ্চিত হয়। 

অলিওসিন ও নিম্ন মায়োসিন প্রনালী - এই সময়ের শিলা সমূহ ভারতবর্ষে খুব বেশি পরিমানে নেই। এটা বলা যায় যে টার্শিয়ারি পরবর্তী সময়ে প্রচুর ক্ষয়কার্যের ফলে এই শিলা সমূহের বিস্তৃতি হ্রাস পেয়েছে। অলিওসিন যুগের শিলাসমূহ মূলত আসামের বারাইল প্রনালীতে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। 
অন্যদিকে আবার মায়োসিন যুগের শিলা সমূহ ভারতবর্ষের বহুলাংশে পাওয়া যায়। এই যুগের শিলা গুলি হল - বেলেপাথর, বালুকাময় শেল, কাদাপাথর, কংগ্লোমারেট। 

শিবালিক প্রনালী - মধ্য মায়োসিন থেকে নিম্ন প্লিস্টোসিন - শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলে বেলেপাথর দ্বারা গঠিত শিলা এই সিস্টেমের অন্তর্গত। এটি প্রায় ৫০০০ মিটার পুরু। প্রচুর জীবাশ্মের উপস্থিতি দেখা যায় এই ধরণের শিলায়। শিবালিক পার্বত্য অঞ্চল ছাড়াও এই ধরণের শিলা কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর ও কেরলের ভারকালাতে এই যুগের শিলা কিছু পরিমানে পাওয়া যায়।  

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.