সমুদ্র তরঙ্গের ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ সমূহ


সমুদ্র তরঙ্গ । সমুদ্র তরঙ্গের শ্রেণীবিভাগ । ফেচ । ঊর্মিভঙ্গ । সমুদ্রতরঙ্গের ক্ষয়কাজ পদ্ধতি । ক্ষয় কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ । সমুদ্র তরঙ্গ ও সমুদ্র স্রোতের পার্থক্য এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হল ।। 

সমুদ্রতরঙ্গ প্রবল বায়ুপ্রবাহের প্রভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের জলরাশি যখন একই স্থানে অবস্থান করে দুই-এক মিটার ওঠানামা করে, তখন তাকে ঢেউ বা সমুদ্র তরঙ্গ বলে
সমুদ্র তরঙ্গের শক্তি নির্ভর করে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগের উপর। আবার বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ নির্ভর করে সমুদ্র জলভাগের ফেচ এর উপর। সমুদ্রের ওপর প্রবাহমান কোন বায়ু যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে অর্থাৎ কোন সমুদ্র তরঙ্গ যে স্থান থেকে শুরু হয় এবং তটরেখা যে স্থানে শেষ হয়, সেই দুটি স্থানের মধ্যে যে দূরত্ব তাকেই বলে ফেচ। 

শ্রেনীবিভাগসমুদ্রজলের আলোড়নের দিক ও সমুদ্রতরঙ্গের প্রকৃতি অনুযায়ী সমুদ্র তরঙ্গের শ্রেনীবিভাগ নিম্নলিখিত ভাবে করা হয়

) সমুদ্রজলের আলোড়নের দিক অনুসারে সমুদ্র তরঙ্গের শ্রেনীবিভাগ

. অনুপ্রস্থ তরঙ্গ অনুপ্রস্থ তরঙ্গ সাধারণত গভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হয় এবং তরঙ্গের জলরাশি ওপর নীচে ওঠা নামা করে

. অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গএই ধরণের তরঙ্গ একক তরঙ্গ হিসাবে উপকূলের দিকে অগ্রসর হয় সাধারণত অনুপ্রস্থ তরঙ্গের অবয়ব ভেঙে যাওয়ার ফলে অগভীর সমুদ্রে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ গঠিত হয়

ঊর্মিভঙ্গসমুদ্র তরঙ্গের অবয়ব গভীর সমুদ্রে একই রকম থাকে সমুদ্র তরঙ্গের অবয়ব টি উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সময় জলের গভীরতা কমতে থাকায় উল্লম্ব জলরাশির সমুদ্র তলদেশের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে বাধা পায় এবং তরঙ্গাবয়বটি কুন্ডলীর আকারে ভেঙে গিয়ে ঊর্মিভঙ্গ সৃষ্টি করে

) প্রকৃতি অনুসারে তরঙ্গের শ্রেনীবিভাগ

. বিনাশকারী তরঙ্গ প্রবল বায়ুপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট যে ঝটিকা তরঙ্গ উপকূলের ব্যাপক ক্ষয়সাধন করে, সেই তরঙ্গকে বিনাশকারী তরঙ্গ বলে এই তরঙ্গের প্রভাবে উপকূলে সোয়াস অপেক্ষা ব্যাকওয়াসের শক্তির তীব্রতা খুবই বেশি হয়

. গঠনকারী তরঙ্গ যে সমুদ্র তরঙ্গ উপকূল ভাগটিকে আরও প্রশস্ত করে, সেই তরঙ্গকে গঠনকারী তরঙ্গ বলে এই তরঙ্গের প্রভাবে উপকূলে সোয়াস অপেক্ষা ব্যাকওয়াশের শক্তির তীব্রতা খুবই কম হয়

সমুদ্র তরঙ্গের ক্ষয়কার্যের পদ্ধতি

সামুদ্রিক ক্ষয় বলতে সমুদ্রতরঙ্গের ক্ষয়কার্যকে বোঝায় সমুদ্র তরঙ্গ প্রধানত চারটি প্রক্রিয়ায় উপকূলের ক্ষয়সাধন করে

) জলপ্রবাহ ক্ষয় প্রবল বায়ুপ্রবাহের ফলে সমুদ্র তরঙ্গ গুলি বারংবার উপকূল ভাগে আছড়ে পরে প্রবল জলের তোড়ে উপকূলের ভূমিভাগ ক্ষয় পায় এই ধরণের ক্ষয়কে জলপ্রবাহ ক্ষয় বলে

) অবঘর্ষ ক্ষয়সমুদ্র তরঙ্গ বাহিত নুড়ি, কাঁকর, বালি ইত্যাদি পদার্থ সমূহ উপকূলের ভূমিভাগে বারংবার আঘাত করলে উপকূলের শিলাস্তর সমূহ ক্ষয় পায় এরূপ ক্ষয়কে অবঘর্ষ ক্ষয় বলে

) ঘর্ষণ ক্ষয় প্রতিনিয়ত সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে উপকূলের বিভিন্ন ধরণের শিলাখন্ড গুলি একে ওপরের সাথে সংঘর্ষের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এরূপ ক্ষয়কে ঘর্ষন ক্ষয় বলে

) দ্রবন ক্ষয় উপকূলের ভূমিভাগ চুনাপাথর, ডলোমাইট কিংবা চক দিয়ে গঠিত হলে, সমুদ্রের জলে মিশ্রিত রাসায়নিক পদার্থ দ্রবন ক্ষয়ের মাধ্যমে উপকূল ভাগ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। 

সমুদ্র তরঙ্গের ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত  ভূমিরূপ 

সমুদ্র তরঙ্গের ক্ষয়কার্যের ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলে নানা প্রকার ভূমিরূপ গঠিত হতে দেখা যায় সাধারণত বিনাশকারী তরঙ্গের প্রভাবে ক্ষয়জাত বিভিন্ন ভূমিরূপ গড়ে ওঠে প্রবল বায়ু প্রবাহের প্রভাবে সমুদ্রের জলরাশি যখন প্রবল বেগে সমুদ্রের দিকে ধেয়ে আসে তখন সেই তরঙ্গ গুলি সমুদ্র উপকূলে ক্ষয় সাধন করে সাধারণত সোয়াস অপেক্ষা ব্যাকওয়াস তরঙ্গের দ্বারা সমুদ্র উপকূল্ভাগ বেশি ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। সমুদ্র তরঙ্গের ক্ষয়কার্যের ফলে নিম্নলিখিত ভূমিরূপ গুলি গঠিত হতে দেখা যায়

১) ভৃগু বা খাঁজকাটা পাড়
ক্রমাগত তরঙ্গের আঘাতে খাঁড়া উপকূলভাগ তটভূমির উচ্চতা বরাবর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেতরের দিকে ঢূকে পড়লে ওপরের অংশটি সমুদ্রের দিকে ঝুকে অবস্থান করে, এরুপ ভূমিভাগ ভৃগু নামে পরিচিত ভৃগু গড়ে ওঠার সময় প্রথমে উপকূলভাগে মসৃন শিলাগাত্রে একটি খাঁজের সৃষ্টি করে, এই খাঁজটি কে ক্যাজম বলে

) তরঙ্গ কর্তিত মঞ্চ প্রবল তরঙ্গের আঘাতে উপকূলের খাঁড়া পাড় বা ভৃগু ক্ষয় প্রাপ্ত হতে হতে ক্রমশ পিছনের দিকে সরে যেতে থাকে এর ফলে খাঁড়া পাড়ের নিম্নাংশে একটি মঞ্চ আকৃতির ভূমিরুপের উদ্ভব ঘটে, একেই বলা হয় তরঙ্গ কর্তিত মঞ্চ

সমুদ্র ভৃগু ও তরঙ্গ কর্তিত মঞ্চ 

) সমুদ্র গুহা কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত খাঁড়া উপকূলভাগের কোন স্থান যদি আলগা শিলা দ্বারা গঠিত হয়, তাহলে সামুদ্রিক ক্ষয় কার্যের ফলে সেই স্থান ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গহ্বরের উদ্ভব ঘটে একেই সমুদ্র গুহা বলে

) স্বাভাবিক সমুদ্র খিলান সমুদ্রের দিকে প্রসারিত কোন স্থলভাগের উভয় দিকে সমুদ্র তরঙ্গ আঘাত করে প্রথমে দুদিকে দুটি গহ্বরের সৃষ্টি করে কালক্রমে গহ্বর দুটির মাঝখানের স্থলভাগের অংশ টুকু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে উভয় মিলিত হয়ে পড়ে ফলে সেখানে গম্বুজাকৃতির স্বাভাবিক সমুদ্র খিলানের উদ্ভব ঘটে

) স্ট্যাক ও স্ট্যাম্প প্রবল তরঙ্গের আঘাতে স্বাভাবিক সমুদ্র খিলানের মাথা ভেঙে গেলে শিলাস্তর থামের মতো দাঁড়িয়ে থাকে এরুপ উপকূলে অগভীর সমুদ্রের বুকে অবস্থিত শিলাস্তর কে বলা হয় স্ট্যাক। এই স্ট্যাক গুলি সমুদ্রতরঙ্গের আঘাতে ক্ষয়ীভূত হয়ে ক্ষুদ্র আকার ধারন করে এবং এগুলির উচ্চতা ক্রমশ সমুদ্র সমতলে নেমে আসে। এই ক্ষুদ্রাকার স্ট্যাক গুলিকে স্ট্যাম্প বলে। 


) ব্লো হোল খাঁড়া সমুদ্র উপকূলে তরঙ্গের আঘাতে সৃষ্ট গুহাগুলি ক্রমশ ক্ষয় প্রাপ্ত হতে হতে অনেক সময় স্থলভাগের উপরে উন্মুক্ত হতে থাকে, এক্ষেত্রে তরঙ্গের আঘাতে গুহার ছাদ ভেঙে গিয়ে উল্লম্ব গর্তের সৃষ্টি হয়, তখন গহ্বরের মাধ্যমে তরঙ্গের জলরাশি বেরিয়ে এসে স্থলভাগের উপর আছড়ে পড়ে, এরুপ গহ্বরকে বলা হয় ব্লো হোল

) জিও সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে অনেক সময় সমুদ্র গুহার ছাদ ধসে গিয়ে একটি সংকীর্ন প্রবেশ পথের সৃষ্টি করে, এগুলি দেখতে অনেকটা স্রু গলির মতো এদের ভিতরে জোয়ারের জল প্রবেশ করে সুতরাং এগুলি খাঁড়িতে পরিনত হয় এরুপ সংকীর্ন খাঁড়িকে স্কটল্যান্ড ও ফ্যারোস দ্বীপে জিও বলা হয়

সমুদ্রতরঙ্গ ও সমুদ্র স্রোতের মধ্যে পার্থক্য

প্রকৃতি – সাধারণত সমুদ্র তরঙ্গ ওপর নিচে ওঠা নামা করে। কিন্তু সমুদ্র স্রোত অনুভূমিক ভাবে চলাচল করে।

স্থানিক পরিবর্তন – সমুদ্রতরঙ্গের ক্ষেত্রে জলরাশি স্থান পরিবর্তন করে না। অন্যদিকে সমুদ্রস্রোতের ক্ষেত্রে জলরাশি স্থান পরিবর্তন করে।

নিয়ন্ত্রক সমূহ – প্রবল বায়ু প্রবাহ ও ভূমিকম্প সমুদ্রতরঙ্গের গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করে। অন্যদিকে প্রবল নিয়ত বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্র জলের উষ্ণতা, লবনাক্ততার তারতম্য ও ভূখণ্ডের অবস্থান সমুদ্র স্রোতের গতিপ্রকৃতি কে নিয়ন্ত্রন করে।

উপকূলের ওপর প্রভাব – সমুদ্র তরঙ্গ উপকূলের ভূমিভাগকে আঘাত করে। কিন্তু সমুদ্র স্রোত উপকূলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়।

জলবায়ুর ওপর প্রভাব – সমুদ্র তরঙ্গ উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু কে প্রভাবিত করে না। অপরদিকে সমুদ্রস্রোত উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু কে প্রভাবিত করে।  

1 টি মন্তব্য:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.