শিল্পের অবস্থান সম্পর্কীত আলফ্রেড ওয়েবারের ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্ব

জার্মান অর্থনীতিবিদ ওয়েবার শিল্পের অবস্থান সংক্রান্ত তাঁর তত্ত্বটি প্রকাশ করেন ১৯০৯ সালে তাঁর তত্ত্বটি ন্যূনতম ব্যয়তত্ত্ব নামে পরিচিত। তাঁর মতে শিল্প সেখানেই গড়ে ওঠে যেখানে ব্যয় ও মুনাফার অনুপাত পজেটিভ হয়

উদ্দেশ্য :– এই তত্ত্বের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল- পরিবহন ব্যয়, মজুরি ব্যয় ও শিল্পের কেন্দ্রীভবনের সুযোগ সুবিধা কে গুরুত্ব দিয়ে সর্বনিম্ন ব্যয় এলাকা সন্ধান করা, যা শিল্প কেন্দ্রের মুনাফাকে সর্বাধিকরনে সাহায্য করে ।

অনুমান সমূহ :–

 ওয়েবার এর তত্ত্বটি এক মাত্র সেখানেই প্রয়োগ সম্ভব যেখানে নিম্নলিখিত এই সমস্ত শর্তের উপস্থিতি থাকবে –

. সমগ্র অঞ্চলটিতে সম প্রকৃতির ভূমিরূপ ও আর্থ সামাজিক অবস্থা বিদ্যমান থাকবে।

. প্রতিযোগিতা মূলক বাজার থাকবে ।

. শ্রমের স্থিতিশীলতা এবং সমগ্র এলাকার মজুরী সমান হবে।

ঈ. পরিবহন ব্যয় সমান ও আনুপাতিক হারে বস্তুর ওজোন ও দিক হিসাবে বৃদ্ধি পাবে।

. ওয়েবার কাঁচা মালকে গুন ও বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করেন –
         
১. সর্বত্র লভ্য কাঁচামাল – যেমন – জল, মাটি, বাতাস
           
২. অবিশুদ্ধ বা ওজোন হ্রাস কারী কাঁচা মাল – যেমন – লৌহ, কপার
           
৩. বিশুদ্ধ শ্রেণীর কাঁচা মাল – যেমন – পাট ও কার্পাস


প্রধান নীতি –

ওয়েবার এর তত্ত্বটি তিনটি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত

  ➤ পরিবহন ব্যয় নীতি

  ➤ শ্রম ব্যয় নীতি

➤  কেন্দ্রীভবন নীতি

পরিবহন ব্যয় নীতি :-

এই নীতি তে তিনি দ্রব্য সূচক (Material Index ) শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, দ্রব্য সূচক (MI) হল কাঁচা মাল ও উৎপাদিত পন্যের ওজোনের অনুপাত।

যদি পন্য সূচকের মান ১ এর বেশি হয় তবে পন্যটি ওজোন হ্রাস কারী কাঁচামাল এবং ১ এর কম হলে পন্য টি বিশুদ্ধ প্রকৃতির।

ওয়েবার এর মতে কাঁচামালের উৎস ও বাজারের অবস্থানের উপর নির্ভর করে শিল্পের অবস্থান বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতির হতে পারে।

তিনি শিল্পের দু রকম অবস্থানের কথা বলেন। যথা –

ক. রৈখিক অবস্থান – শিল্প যখন একটি বাজার ও একটি বিশুদ্ধ কাঁচামালের উৎসের মধ্যবর্তী স্থানে অথবা বাজার ও একটি অবিশুদ্ধ বা ওজন হ্রাস কারী কাঁচামালের মধ্যে অবস্থান করে, তখন এই রূপ রৈখিক অবস্থান দেখা যায়।  

. অরৈখিক অবস্থানযখন শিল্প একটি বাজার ও দুটি অবিশুদ্ধ কাঁচামালের উৎসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে
       
ক. রৈখিক অবস্থান

বিশুদ্ধ শ্রেনীর কাঁচামালের ক্ষেত্রে শিল্প বাজারের নিকট, কাঁচামাল উৎসের নিকট কিংবা দুটির মধ্যবর্তী যে কোনো জায়গায় গড়ে ওঠতে পারে। সাধারনত বিশুদ্ধ শ্রেনীর কাঁচামালের ক্ষেত্রে শিল্প বাজারের নিকট গড়ে ওঠার প্রবনতা দেখা যায়। 

যেমন- কার্পাস বয়ন শিল্প, চামড়া শিল্পের ক্ষেত্রে রৈখিক অবস্থান দেখা যায়

➤ অবিশুদ্ধ বা ওজন হ্রাসকারী কাঁচামালের ক্ষেত্রে  শিল্প কোথায় গড়ে উঠবে তা নিচে বণর্না করা হল 

ওয়েবার শিল্পের অবস্থান ব্যয় নির্নয়ের জন্য পরিবহন ব্যয় ১টাকা/ইউনিট/কিমি ধরে নেন

ধরা যাক, বাজার ও কাঁচামালের উৎসের মধ্যে দূরত্ব ১০০ কিমি ও কাঁচামাল প্রযোজন ২ ইউনিট এবং উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ ১ ইউনিট কারণ এটি অবিশুদ্ধ কাঁচামাল। 

তাহলে 

       শিল্প কেন্দ্র বাজারে অবস্থিত হলে মোট পরিবহন ব্যয় =×১০০ = ২০০ টাকা

       শিল্প কেন্দ্র কাঁচামালের উৎসে অবস্থিত হলে মোট ব্যয় =×১০০ = ১০০ টাকা (ন্যূনতম ব্যয় অবস্থান )

       শিল্প কেন্দ্র  X এ অবস্থিত হলে মোট ব্যয় = (২×৫০) + (১×৫০) = ১৫০ টাকা হবে।

অর্থাৎ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একটি অবিশুদ্ধ কাঁচামাল ভিত্তিক শিল্প সবসময় সেই কাঁচামালের উৎসের নিকট গড়ে ওঠে। 

খ. অরৈখিক অবস্থান

অরৈখিক বা ত্রিভূজাকৃতি অবস্থানের ক্ষেত্রে শিল্প বাজার, ১ম কাঁচামালের উৎস, ২য় কাঁচামালের উৎস অথবা মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে উঠতে পারে।

এক্ষেত্রে দুটি কাঁচামালই অবিশুদ্ধ প্রকৃতির ।

ধরি, প্রথম কাঁচামাল প্রয়োজন – ২ ইউনিট

      দ্বিতীয় কাঁচামাল প্রয়োজন – ৫ ইউনিট

     উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ - ১ ইউনিট কারণ এটি ওজন হ্রাসকারী কাঁচামাল এবং 

     বাজার ও দুটি কাঁচামালের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১০০ কিমি।


শিল্পের অবস্থান –

 বাজারে = (২×১০০) + (৫×১০০) = ৭০০ টাকা

১ম কাঁচামাল উৎস = (৫×১০০) + (১×১০০) = ৬০০ টাকা

২য় কাঁচামাল উৎস = (২×১০০) + (১×১০০) = ৩০০ টাকা (ন্যূনতম ব্যয় অবস্থান )

মধ্যবর্তী স্থানে = (৫×৫০) + (২×৫০) + (১×৫০) = ৪০০ টাকা 

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে কাঁচামালটি সব থেকে বেশি পরিমানে লাগছে, সেখানে শিল্প স্থাপন করলে পরিবহন ব্যয় লাগছে সব থেকে কম। 

আইসোটিম – সমান পরিবহন ব্যয় যুক্ত অঞ্চল গুলিকে যুক্ত করলে যে রেখা পাওয়া যায়, তাকে আইসোটিম বলে ।


আইসোডোপেন – একই মোট পরিবহন ব্যয় যুক্ত অঞ্চল গুলো কে যুক্ত করলে আইসোডোপেন পাওয়া যায় । অর্থাৎ কাঁচামালের পরিবহন ব্যয় সংক্রান্ত আইসোটিম এবং উৎপাদিত পন্য পরিবহন ব্যয় সংক্রান্ত আইসোটিম পরস্পর কে যে বিন্দু তে ছেদ করে, সে বিন্দু গুলো কে যুক্ত করলে আইসোডোপেন পাওয়া যায়।


শ্রম  ব্যয় নীতি – ওয়েবার মনে করেন শিল্পের অবস্থানে শ্রমিক মজুরি ব্যয় গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার মতে যে সব স্থানে অল্প মজুরি তে শ্রমিক পাওয়া যায়, সে সব ক্ষেত্রে শিল্প ন্যুনতম পরিবহন এলাকা তে গড়ে না উঠে ন্যূনতম মজুরি ব্যয় এলাকায় শিল্প স্থাপিত হবে, যদি মজুরি ব্যবদ ব্যয় অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় (নতুন জায়গায় শিল্প স্থানান্তরের জন্য পরিবহন ব্যয়) থেকে কম হয়।

ক্রিটিক্যাল আইসোডোপেন – যে লাইন বরাবর শিল্পের স্থানান্তরিত জনিত কারণে পরিবহন খরচ ও শ্রম মজুরি থেকে সঞ্চয়ের পরিমান সমান হয়, তাকে ক্রিটিক্যাল আইসোডোপেন বলে।

একটি উদাহরনের সাহায্যে বোঝা যাক –



ধরাযাক – L1, L2 ও L3 কেন্দ্রে শ্রমিক মজুরি ব্যয়ে ৩ টাকা সঞ্চয় হয় এবং R2 ন্যূনতম পরিবহন ব্যয় কেন্দ্র।

এবার উপরের চিত্র অনুসারে R2 থেকে শিল্প কেন্দ্র  L1 কেন্দ্রে স্থাপন করলে শ্রম মজুরি থেকে সঞ্চয় হবে ৩ টাকা এবং L1 কেন্দ্রে শিল্প স্থাপন করতে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ হবে ২.৫ টাকা আইসোটিম অনুসারে ।

তাহলে L1 কেন্দ্রে শিল্প কেন্দ্র গড়ে উঠলে (৩-২.৫) =  0.৫ টাকা সঞ্চয় হবে।

L2 কেন্দ্রে

অতিরিক্ত পরিবহন খরচ হবে ৩.০ টাকা - শ্রম মজুরি থেকে সঞ্চয় হবে ৩.০ টাকা = ০ (ক্রিটিক্যাল আইসোডোপেন)

L3 কেন্দ্রে

অতিরিক্ত পরিবহন খরচ হবে ৩.৫ টাকা - শ্রম মজুরি থেকে সঞ্চয় হবে ৩.০ টাকা = .৫ টাকা ক্ষতি

অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে শিল্প টি L1 কেন্দ্রে গড়ে উঠবে।

কেন্দ্রীভবন নীতি – অনেক সময় একটি নিদিষ্ট স্থানে একের বেশি শিল্প কেন্দ্রের সমাবেশ শিল্প কেন্দ্র গুলি কে নানা ভাবে লাভ বান হতে সাহায্য করে।

যেমন – একটি মাত্র শিল্প কেন্দ্রের সমাবেশ হলে, উক্ত শিল্প কেন্দ্র টিকে রাস্তা নির্মানের জন্য সমস্ত ব্য়য়ভার বহন করতে হত।

ধরা যাক রাস্তা নির্মান করতে ওই শিল্প কেন্দ্রটির খরচ ১০০০ টাকা, কিন্তু সেখানে যদি ৫ টি অন্যান্য শিল্প কেন্দ্র গড়ে ওঠে তাহলে সে ক্ষেত্রে প্রতিটি কেন্দ্রের খরচ পরবে ১০০০/৫ = ২০০ টাকা

তাই নতুন শিল্প কেন্দ্র গুলি শিল্প সমাবেশের মধ্যে গড়ে ওঠার চেষ্টা করে।




কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.