বায়ু দূষণের কারণ ও প্রতিকারের উপায়



বায়ুদূষণের কারণ ও তার প্রতিকার গুলি এখানে আলোচনা করা হল ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে – পারিপার্শ্বিক বায়ুতে কিছু কিছু বস্তু যথেষ্ট পরিমানে মিশ্রিত হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য মানুষ ও তার পরিবেশ ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে বায়ুদূষণ বলে।

পরিবেশবিদ পার্কিন্স তাঁর রচিত ‘Air Pollution’ বইতে বলেছেন যেন – ঘরের বাইরের আবহমণ্ডলে এক বা একাধিক সংক্রামক বস্তু যেমন – বিষাক্ত ধোঁয়া, ধূলিকনা, গ্যাস, কুয়াশা, কাঁকর, ধোঁয়াশা অথবা বাস্পের যে পরিমান উপস্থিতি ও যতক্ষন স্থায়ী হলে মানুষ, জীবজন্তু অথবা উদ্ভিদ জগতের পক্ষে ক্ষতিকারক, তাকেই বায়ুদূষক বলা হয়

উপরিউক্ত সংজ্ঞা দুটির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের পারিপার্শ্বিক বায়ুমণ্ডলে অবাঞ্ছিত ও দূষিত পদার্থের উপস্থিতি বিপর্জ্জনক মাত্রা অতিক্রম করলে জীবজগতের পক্ষে যে ক্ষতি হয়, তাকে বায়ুদূষণ বলে।

প্রাথমিক বায়ুদূষক – প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উৎস থেকে উৎপন্ন যে সব দূষক সরাসরি বায়ুতে মিশে বায়ু দূষণ করে তাদের প্রাথমিক বায়ুদূষক বলে। এই দূষক গুলি হল – কার্বনের অক্সাইড(CO), নাইট্রোজেনের অক্সাইড, সালফারের অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন এছাড়া ধোঁয়া, ফ্লাই অ্যাস, ধূলিকনা, পরাগরেনু ও বিভিন্ন প্রকার ভাইরাস। বিশ্ব বায়ুদূষণের প্রায় ৯০ শতাংশ এই প্রাথমিক বায়ুদূষকের দ্বারা হয়ে থাকে।

গৌন বায়ুদূষক – সূর্যালোকের উপস্থিতিতে বা সূর্যালোকহীন অবস্থায় দুই বা ততোধিক প্রাথমিক বায়ুদূষ্ক বিক্রিয়া ঘটিয়ে কিংবা বাতাসের স্বাভাবিক উপাদান ও বায়ুদূষকের মধ্যে বিক্রিয়ায় যেসব দূষক উৎপন্ন হয়, তাদের গৌন বায়ুদূষক বলে। এগুলি হল – সালফিউরিক অ্যাসিড, অম্লবৃষ্টি, ধোঁয়াশা, পারঅক্সি অ্যাসাইল নাইট্রেট।

বায়ুদূষণের কারণ গুলি হল – বায়ুদূষণ সৃষ্টিকারী সংক্রামক উপাদান গুলির উৎস কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা –
প্রাকৃতিক কারণ – প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্গত পদার্থ দ্বারা বায়ু দূষিত হলে তাকে প্রাকৃতিক দূষক বলে। প্রাকৃতিক উপায়ে বায়ু বিভিন্ন ভাবে দূষিত হয়, যেমন –

১. দাবানল – বজ্রপাত, লাভাপ্রবাহ, গাছে গাছে ঘর্ষন প্রভৃতি কারণে বনভূমিতে আগুন লেগে দাবানলের সৃষ্টি হয়। এভাবে বনভূমি পুড়ে গিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, ছাই ইত্যাদি বায়ুদূষন ঘটায়।

২. অগ্ন্যুৎপাত – অগ্ন্যুৎপাতের সময় আগ্নেয়গিরি থেকে প্রচুর পরিমানে  কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড নির্গত হয়ে বায়ুকে দূষিত করে। অগ্ন্যুৎপাতের সময় মোট সালফারের প্রায় ৭০% বাতাসে মিশে।

৩. ধূলিঝড় – মরুপ্রায় ও মরুঅঞ্চলে দিনের বেলায় প্রচন্ড উত্তাপে ধূলিঝড়ের সৃষ্টি হয়। এই ধুলিঝরের ফলে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ধূলিকনা বাতাসে মিশে বায়ুর ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।

৪. পচন – মৃত জীবদেহের পচনের ফলে অনেক ধরণের দূর্গন্ধ যুক্ত গ্যাস যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বাতাসের সাথে মিশ্রিত হয়ে বায়ু দূষণ ঘটায়।

৫. মহাজাগতিক বস্তু – মহাকাশ থেকে ভূপৃষ্টে আগত উল্কাপিন্ড, মহাজাগতিক ধূলিকনা প্রভৃতি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়।

মনুষ্য সৃষ্ট কারণ – মানুষের প্রতিনিয়ত কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত বস্তু বাতসে মিশ্রিত হচ্ছে, এগুলি কে মনুষ্য সৃষ্ট কারণ বলে।

১. কলকারখানা – শিল্পাঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, ধাতব কনা, ধোঁয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমানে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে।

২. যানবাহন – বিভিন্ন যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানীর (পেট্রোল ও ডিজেল) দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকার গ্যাস নির্গত হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনোক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এছাড়া যানবাহনের ধোয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেনের অক্সাইড থাকে যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে। যানবাহনের আধিক্যের জন্য শহরাঞ্চলের বাতাস বেশি দূষিত হয়।

৩. তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র – কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, সালফারের অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস ছাড়াও প্রচুর পরিমানে ছাই বাতাসে মিশে বায়ুদূষন ঘটায়। পৃথিবীর মোট সালফার দূষণের প্রায় ৩০ শতাংশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দহনের ফলে বাতাসে মিশ্রিত হয়।

৪. পারমানবিক কেন্দ্র – পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লিথেকে প্রচুর পরিমানে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বেরিয়ে বাতাসে মিশে বায়ুকে দূষিত করে।

৫. অন্যান্য দূষক –
  • অরণ্য ধবংসের ফলে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের ভারসাম্য নষ্ট ।
  • আবর্জনা পড়ানোর ফলে উৎপন্ন ধোঁয়া, ছাই ও জৈব ফসফেট।
  • শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র থেকে নির্গত CFC বাতাসে মিশে ওজোন ধ্বংস করছে।

বায়ুদূষণের নিয়ন্ত্রন – বায়ুমন্ডল কে দূষণ মুক্ত রাখতে নিম্নলিখিত পদ্ধতি গুলি অবলম্বন করা প্রয়োজন ।

১. বনসৃজন – গাছ অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে তাই প্রচুর পরিমানে বৃক্ষ রোপন করলে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হয়।

২. অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার – জীবাশ্ম জ্বালানি দহনে বাতাস বেশি দূষিত হয়। তাই এগুলির পরিবর্তে দূষণ মুক্ত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার ভাটার শক্তি প্রভৃতি ব্যবহার করা প্রয়োজন।

৩. বিশুদ্ধ জ্বালানীর ব্যবহার – সালফার বিহীন কয়লা ও সিস বিহীন পেট্রোল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে যানবাহন চালানো আবশ্যিক করে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।

৪. বায়ু পরিশোধক যন্ত্র স্থাপন – বায়ুদূষণের উৎস গুলিতে বায়ু পরিশোধক যন্ত্রপাতি স্থাপন করলে বায়ু দূষণের পরিমান হ্রাস পায়। শিল্পকারখানা , তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতির চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া কে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটরের মাধ্যমে বায়ু থেকে ধূলিকনা পৃথক করে এবং গাড়িতে ক্যাটালেটিক কর্নভার্টার বসিয়ে বায়ুদূষন হ্রাস করা যায়।

৫. উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন –কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে, যেমন – কৃষিতে রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব কীটনাশক এবং শিল্পক্ষেত্রে দূষণকারী কাঁচামাল ব্যবহার না করলে বায়ুদূষন হ্রাস করা সম্ভব।

৬. আইন প্রনয়ন – কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদ দ্বারা ১৯৮১ সালে বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রন আইন প্রয়োগ করে দূষণ কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।

৭. জনসচেতনতা – বায়ুদূষণের উৎস বা কারন এবং কুফল সম্পর্কে জনসাধারনের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগিয়ে তুললে বায়ু দূষণ রোধ করা সম্ভব। 

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.