মনুষ্য সৃষ্ট শিল্প বিপর্যয়

মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন ধরণের দূর্ঘটনা, যেগুলি বহু সংখ্যক মানষের প্রানহানী ঘটিয়েছে, প্রাকৃতিক পরিবেশে বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে, প্রচুর সম্পদের ক্ষতি করেছে, সেই রকম বেশ কিছু মনুষ্য সৃষ্ট ঘটনা এখানে আলোচনা করা হল। 

পৃথিবীর প্রধান প্রধান পারমানবিক বিপর্যয় 

চারনোবিল পারমানবিক দূর্ঘটনা 
ইউক্রেনের চারনোবিলের পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পারমানবিক দূর্ঘটনা হিসাবে বর্ননা করা হয়। মানুষের ত্রুটি জনিত কারনেই এই দূর্ঘটনাটি ঘটেছিল। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুরক্ষা সম্পর্কীত পরীক্ষা করার সময়, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দূর্ঘটনা এড়ানোর জন্য যে সব বিধিনিষেধ অবলম্বন করা উচিত ছিল সে গুলো পালন করা হয়নি, যার ফলই ছিল বিস্ফোরণ। 

থ্রি মাইল আইল্যান্ড দূর্ঘটনা 
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার হ্যারিসবার্গ ঘটে যাইয়া থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমানবিক দূর্ঘটনাটি ছিল ব্যাপক ও সূদুর প্রসারি প্রভাব যুক্ত। বর্তমান সময়ের শিল্প কেন্দ্রিক ভয়ঙ্কর বিপর্যয় গুলির মধ্যে একটি হল থ্রি মাইল আইল্যান্ড দূর্ঘটনা। ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ সকাল চার টাই যখন এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি তার উৎপাদন ক্ষমতার ৯৭% ব্যবহার করছিল, তখন এই দূর্ঘটনাটি ঘটেছিল। 

ফুকোসিমা পারমানবিক দূর্ঘটনা 
২০১১ সালে ১১ই মার্চ জাপানে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে ফুকোসিমা পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে প্রচুর তেজস্ক্রিয় রশ্মি চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছিল।

রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণ 

ভূপাল গ্যাস দূর্ঘটনা 
১৯৮৪ সালের ২ রা ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের ভূপালে ইউনিয়ন কার্বাইড কীটনাশক তৈরির কারখানায় প্রবল বিস্ফোরনের ফলে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন মতো বিষাক্ত মিথাইল আইসো সায়ানেট (মিক গ্যাস) নির্গত হয়। যার ফলে প্রায় ২২৫৯ জনের প্রানহানী ঘটে, প্রায় ১ লক্ষ মতো মানুষ আহত হয়। ভূপাল গ্যাস দূর্ঘটনা পৃথিবীর শিল্প কেন্দ্রিক বিপর্যয় গুলির মধ্যে বৃহত্তম। এই বিষাক্ত মিক গ্যাসের প্রভাবে এখনো অনেক শিশু পঙ্গু অবস্থায় জন্মগ্রহন করে। 

টেক্সাস রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণ 
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম টেক্সাসে অবস্থিত একটি সার তৈরির কারখানায় ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল অগ্নি সংযোগের ফলে ওই কারখানায় সঞ্চিত ২০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটে প্রবল বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। যার ফলে ১৪ জন মারা যান, ১৬০ জন আহত হন এবং বিস্ফোরনের তীব্রতা এতোটা বেশি ছিল যে   ১৫০ টি  বাড়ির ক্ষতি হয়। 

বেরুট বিস্ফোরণ 
পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী একটি দেশ লেবানন এবং লেবাননের রাজধানীর নাম বেরুট। এই শহরের বেরুট বন্দরের গুদাম ঘরে অনেক দিন থেকে সঞ্চিত থাকা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটে অগ্নি সংযোগের কারণে ২০২০ সালে ৪ ই আগস্ট প্রবল বিস্ফোরণ ঘটে, যার শব্দ প্রায় ২৪০ কিমি দূরবর্তী জায়গা থেকে শোনা যায় এবং ৩.৩ তীব্রতার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই বিস্ফোরনের ফলে ২০৪ জন মারা যান, ৬৫০০ জন আহত হন এবং প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। 

বিশাখাপত্তনম গ্যাস দূর্ঘটনা 
২০২০ সালের ৭ ই মে  অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম শহরের বাইরের দিকে অবস্থিত LG Polymers নামক একটি রাসায়নিক কারখানা থেকে বিষাক্ত Styrene গ্যাসের নির্গমনের ফলে ১১ জন মানুষের মৃত্যু হয় ও প্রায় ১০০০ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে পরে। 

তেল নির্গমন জনিত দূর্যোগ 
অনেক সময় তৈলবাহী ট্যাঙ্কার, তৈলবাহী পাইপ লাইন ফুটে হয়ে প্রচুর পরিমানে তেল জল ও স্থল ভাগে ছড়িয়ে পরে। প্রচুর তেলের নির্গমনের ফলে জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত জীবপ্রজাতির প্রচুর ক্ষতি সাধিত হয়। বিশেষ করে জলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত মাছ, প্রবাল কীট ও অন্যান্য জলজ প্রানীর বিপুল পরিমানে প্রানহানী ঘটে। জলজ বাস্তুতন্ত্রের অপূরনীয় ক্ষতি সাধিত হয়। তেল নির্গমন বা Oil Spill সম্পর্কীত কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হল 

এক্সোন ভালডেজ অয়েল স্পিল 
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তেল নির্গমন জনিত ঘটনা গুলির মধ্যে বৃহত্তম হল এক্সোন ভালডেজ অয়েল স্পিল। এক্সোন মোবিল কর্পোরেশনের মালিকানাধিন তৈলবাহী Exxon Valdez জাহাজটি ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে আলাস্কার নিকটে অবস্থিত ব্লিঘ প্রবাল দ্বীপে আঘাত পেয়ে ট্যাঙ্কারে বড়ো আকারের একটি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। সেই ছিদ্র দিয়ে প্রায় ৪২ মিলিয়ন লিটার পেট্রোল প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার অঞ্চলব্যাপী ছড়িয়ে পরে। যা সেখান কার স্থানীয় পরিবেশকে সম্পূর্ন রূপে ধ্বংস করে দেয়। ৬ লক্ষের বেশি পাখি, ৫৫০০ টি সামুদ্রিক উদ, ৩০ টি সিল ও ২২ টি তিমি ও আরো অসংখ্য প্রানী মারা যায়।  

গালফ ওয়ার অয়েল স্পিল/ Gulf War Oil Spill 
১৯৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় দেশ গুলির মধ্যে যুদ্ধের সময় ইরাকী সৈন্যরা কুয়েত থেকে ফেরার সময় আমেরিকান সৈন্যকে বাঁধা দেওয়ার জন্য কুয়েতের তেলের কূপ ও পাইপ লাইন গুলির ঢাকনা খুলে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। যার ফলস্বরূপ ২৪০-৩৩৬ মিলিয়ন গ্যালন খনিজ তেল পারস্য উপসাগরে পতিত হয়। যা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের আয়তনের সমান এলাকায় ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে প্রায় ৫৯ মিলিয়ন গ্যালন তেল উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এটি ছিল সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম অয়েল স্পিল। যদিও এর ফলে প্রবাল ইকোসিস্টেম ও মাছের স্থায়ী ক্ষতি হলেও অর্ধেক বাষ্পীভূত হয়ে যায়, ১/৮ অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়। 

আটলান্টিক এমপ্রেস অয়েল স্পিল
১৯৭৯ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ত্রিনিদাদ টোবাগো দ্বীপের উপকূল বরাবর এক ঝড়ের রাতে দুটি তৈলবাহী ট্যাঙ্কারের সংঘর্ষের ফলে প্রায় ৮৮ মিলিয়ন গ্যালন খনিজ তৈল সমুদ্রে ছড়িয়ে পরে। দুটি ট্যাঙ্কারেই পরবর্তী কালে আগুন লেগে যায়। প্রায় ২৬ জন মতো জাহাজের কর্মী মারা যান এই দূর্ঘটনায়। 

রাশিয়া অয়েল স্পিল 
২০২০ সালের জুন মাসে রাশিয়ার সাইবেরিয়ান শহর নোলিস্কে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিকট একটি তেলের ট্যাঙ্ক ভেঙে যাওয়ার ফলে প্রায় ২০০০০ টন ডিজেল পার্শ্ববর্তী আম্বারনায়া নদীতে গিয়ে মিশে এবং সেই তেল নদীর নিম্নগতির প্রায় ৭ মাইল দূরের জলকে দূষিত করে দেয়। 

মরিশাস অয়েল স্পিল 
২০২০ সালের আগস্ট মাসে জাপানের একটি তৈলবাহী জাহাজ তেল আরবীয় দেশ থেকে তেল নিয়ে ফেরার পথে ভারত মহাসাগরের প্রবাল দ্বীপ রাষ্ট্র মরিশাসের উপকূলের নিকট অগভীর উপকূলে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায়, যার ফলে সেই জাহাজে বহনকারী ৪০০০ টন তেলের প্রায় ১০০০ টন তেল সমুদ্রে মিশে যায়, যা মরিশাস উপকূলের প্রবাল বাস্তুতন্ত্র কে ধ্বংসের মুখে ঢেলে দেয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

Deejpilot থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.